অসুখের সকাল সন্ধ্যা (চিঠি – ১০)

প্রিয় জয়ন্তী,

মাথা ধরে আছে অনেকক্ষন ধরেই। বাইরে প্রচণ্ড রোদের উত্তাপ। সকাল মাত্র গড়িয়েছে। আজ আমার কাজে জাওয়া হয়নি। জয়া অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে গত ২ দিন। প্রথম দিনটা খুব বাজে ভাবে বেচারিয়ে ভুগিয়েছে। আমি মানুষের শারীরিক সমস্যা খুব ভালভাবে নিতে পারি না। আমি খুব সাবধানে জয়াকে নানা রকম সহযোগিতা করে যাচ্ছি। এই কাজ গুলি করতে যেয়ে আমার সঙ্কোচ হচ্ছে কেন জানি। বারংবার মনে হচ্ছে যেন আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়ত তোমাকে আর বেশি সহযোগিতা কিংবা শুস্রশা দিতে পারত। আমি হয়তো সবকিছু ঠিক ভাবে করতে পারছি না। তোমার আরও কিছু সহযোগিতার হয়তো দরকার ছিল। আমরা শেষ হলিডেতে ব্লু অকোয়া তে সাঁতার কেটেছিলাম বিকেলে। সেদিন রাতেই প্রচণ্ড জড় নিয়ে জয়া ঘুমিয়ে গেছে। আমি টের পাইনি। অনেক রাতে হটাৎ আমাকে প্রচণ্ড জোরে আঁকড়ে ধরে। মনে হচ্ছিল আমার পিঠে বুঝি প্রচণ্ড গরম কোন কিছু হটাৎ লেগে গেছে। কেঁপে কেঁপে উঠছিল জয়া। আমি খুব নার্ভাস হয়ে যাই এইসব মুহূর্তে। কিন্তু আশার কথা সে খুবই কঠিন ধাঁচে গড়া। আমাকে একের পর এক বলে যাচ্ছিল কি কি করতে হবে। আর আমি কিছুটা দিগভ্রান্তের মত ছোটা ছুটি করে যাচ্ছিলাম। রাতেই জ্বর কিছুটা কমিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম। জ্বর দিনের একটা সময় নিয়ম করে আসে। সন্ধ্যার পরে জ্বর বাড়ে আবার মাঝ রাতে ছেড়ে যায়। আজ সন্ধ্যায় দেখব যদি জ্বর আসে তবে হয়ত মেডিকেলে নিয়ে জাওয়ার কথা ভাবতে হবে। জয়ার অফিশিয়াল মেডিকেল সিস্টেমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের পরামর্শ মতই সব করা হচ্ছে। গতকাল একবার শুধুমাত্র দুপুরে আমি অফিস এ ঢু মেরে এসেছিলাম ঘণ্টা ২-১ এর জন্য।

মানুষের অসুস্থতা আমাকে খুব সহজেই এলোমেলো করে ফেলে। এমনকি আমি নিজের অসুস্থতায়ও খুব কাতর হয়ে যাই। আমার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে নাড়া দিয়ে যায়। আমি এখন জয়ার এই সামান্য জ্বর নিয়েই ভাবছিলাম। যদিও এতটা গভীর ভাবে এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। জয়া বিছানার এক পাশে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ভেড়ানো দরজার ফাঁক গলে সামান্য অবয়ব দেখা যাচ্ছে ওর শরীরের। জয়া এখন কিচ্ছুক্ষণ ঘুমুবে। আমি চাইলে কিছুক্ষণ অফিস থেকে ঘুরে আসতে পারি। যদিও আমি সে পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছি। ডেমিয়েন কে আসতে বলেছি বিকেলে। গুমট লাগছে আমার একা একা। ডেমিয়েন জারাকেও নিয়ে আসবে। ডেমিয়েন মনে হয় সবাইকেই আসতে বলেছে। আমি লীনচ আর আর এরিনার মেসেজ পেয়েছি আজ বিকেলে তারা আসবে এখানে। আমি এখন একটা কাজ করব, সেটা হল সন্ধ্যায় একটা ছোট বারবিকিউ এর ব্যাবস্থা করতে হবে। ওদের বিকেলটা একটু ভাল কাটুক আর জয়ারও একটু চেঞ্জ দরকার। মল্টভ স্টোভটা রেডি করে রাখতে হবে। কিছু মাছ আর মুরগি মেরিনেড প্রস্তুত করে রেখেছি কিছুক্ষণ আগে। আর এখানেই বারান্দা লাগোয়া একটা বসার ব্যাবস্থা করতে হবে। লনটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। পাতা পড়ে জমে আছে। যদিও হলদে রঙয়ের স্প্রুইশ এর পাতা দেখতে খারাপ ও লাগছে না।

যেকোনো কারনেই হোক আমি বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। একটু পরপর আমি খোলা দরজাটার ফাঁক দিয়ে জয়ন্তীকে দেখছি। মনে হচ্ছে অনেক গল্প অনেক কথা ঘুমিয়ে আছে ক্লান্ত হয়ে। জীবনের আসলে মানেটা কি ! আমরা শুধু কোন কিছুর ছাপ ফেলে যাওয়ার চেষ্টাই করে যাচ্ছি শুরু থেকে শেষটা পর্যন্ত। কারও হৃদয়ের খুব গভীরে কোন কিছুর স্মৃতি অথবা দুঃখ- সুখের পাঁচালি। হৃদয়ে কি আসলেও কিছু দাগ রয়ে যায় ? সকালের রোদ যেমন এই বাগানের ঘাসে আলো ছড়িয়ে বিকেলে হারিয়ে যায়। কই ! আমি তো আর রোদের কোন দাগ  খুঁজে পাই না। তবেকি স্মৃতির ব্যাথা বয়ে বেড়ানোটা শুধু মানুষের মাঝেই বিদ্যমান? হটাৎ করেই কিছুই আর যেন ভাল লাগে না আমার। বিভ্রান্ত ভাবনা গুলি আমাকে পেয়ে বসে আবারও।

দূরে বাগানের শেষ প্রান্তে যেখানে লম্বা গাছের সারি শুরু ঠিক ওখানে কিছু কাঠবিড়ালী ছোটা ছুটি করছে। চারদিকে এত বেশি নিস্তব্ধতা যে কাঠবিড়ালীদের দৌর ঝাঁপও স্পষ্ট কানে বাজে। আমি একবার এই কাঠবিড়ালি একটা ধরে ছিলাম। বেচারা নেহায়াত লোভের বসে ধরা খায়। আমি কিছু শুকনো রুটির লোভ দেখিয়ে একটা বাক্সে ঢুকিয়ে আটকে ফেলি। মানুষ সম্পর্কে এদের ধারনা খুব কম! আমার কেন জানি অদ্ভুত একটা প্রশান্তি ছুঁয়ে যাচ্ছে। অনেক বড় কোন মানবিক টানাপোড়নেও হয়ত মানুষের বিচলিত মন শান্তি খুঁজে ফেরে। কিছু কাজ শেষ করতে হবে। ছাদের স্কাই ভিউ পরিষ্কার করতে হবে। গ্যারেজ পরিষ্কার করতে হবে আর মিউনিসিপ্যাল রক্ষনাবেক্ষন ডিপার্টমেন্টকে বাগান, লন আর সুইমিং পুলের সার্ভিস শিডিউল হালনাগাদ করতে বলতে হবে। এত বড় লন আর বাগান নিজেদের পক্ষে নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখা সম্ভব নয়। মিউনিসিপ্যাল এর একটা বিশেষ শাখা আছে যারা নির্দিষ্ট আয়তনের থেকে বড় উঠান বা বাগান গুলি পরিষ্কার করে দেয়। তবে তাদের বেশ ভাল সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। আমরা কাজটা ২ পর পর করি। এবার প্রায় দুমাসের বেশি হয়ে গেছে।

সাইকেল নিয়ে বাগানের মধ্যে ঢুকে জাওয়া যায়। কিছুক্ষন সাইকেল চালাতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি মাঝে মাঝে চলে জাই জঙ্গলের একটু ভেতরের দিকটায়। বনের পাশ জুড়ে অকোয়া নদীর তীর। আমার বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু দূরে জাওয়া যাবে না। জয়া উঠে খুঁজবে হয়তো। চিন্তা ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ল। মেইন গেটের বাইরে গাড়ি থামার শব্দ পেলাম যেন। হা আমার ধারনা সত্যি। পকেট গেট ঠেলে ভিক্টরকে ঢুকতে দেখলাম। সে মেইন গেটটা খুলে গাড়িটা লনের পাশে পারকিং করে রেখে ঘরের দিকে এগুচ্ছে। তার হাতে ধরা একটা বড় প্যাকেট। আমাকে সে দেখতে পায়নি, কারন আমি এই ঝোপটার আড়ালে ছিলাম। আমি এখান থেকে তাকে ডাক দিলে বেচারা চমকে যাবে। তারচে বরং অপেক্ষা করি তার দরজায় কড়া নাড়া পর্যন্ত। সে বোতাম চেপে নিজের নাম বলে ইতি উতি তাকাতে থাকল। আর ঠিক তখনই আমি হাত নেড়ে তার নজর কাড়ার জন্য ইশারা করতেই সে বললও “কি খবর ? জয়া কেমন আছে” জানতে চাইল। অবস্থা আগের থেকে স্থিতিশীল বলার পরেই সে কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গি নিয়ে বলল সে বিকেলে থাকতে পারবে না আজকে তাই একটু আগেই দেখা করার জন্য চলে এসেছে। বিকেলে তার ডিউটি। ভিক্টর স্থানীয় অগ্নি নির্বাপণ সংস্থার প্রকৌশলী দলের একজন সদস্য। আমাদের অনেক পুরনো বন্ধু সে। বলা যায়  প্রায় এই শহরে প্রথম দিকে যাদের আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছিল তাদের একজন ভিক্টর। ভিক্টর আমাকে একটা আলিঙ্গন দিয়ে মনে করিয়ে দিল আমি তাকে প্রায় ভুলেই গেছি। কিছু বলতে চাইলাম তার আগেই এক দফা গালি দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে দিল। ভিক্টরকে বসিয়ে রেখে জয়াকে ডেকে তোলার জন্য রুমে ঢুকতেই দেখি জয়া বাথরুম থেকে বেরুচ্ছে। চোখ গুলি বসে গেছে, চুল গুলি এলোমেলো। আমাকে দেখেই এক চিলতে হেসে বলল অনেকটা ঘুমানতে তার কিছুটা ভাল লাগছে। বিকেলের জন্য সব কিছু আমি প্রস্তুত করেছি কিনা ? আমি তাকে ভিক্টর এর কথা বলতেই সে বলল ভিক্টরের এত তারাতারি আসার কথা নয়। সে আসবে সবার শেষে। এসেই একটা কিছু খাবার খুঁজে নিয়ে তার কোন এক সিনিয়র বস কে গালি দিতে শুরু করবে। এটাই নিয়ম। ভিক্টরের বিকেলের শিফটের ডিউটির কথা বলতেই জয়া বলল, দেখত ও কি খাবে? বেচারা তো আগেই চলে যাবে, ওকে কিছু খাওয়াও তাহলে। আর এখানে বারান্দায় চলে এসো তোমরা। আমার ক্ষুধা পেয়েছে, আমাকে কিছু রুটি গারলিক টোস্ট করে দাও। আমরা একসাথে লাঞ্চ সেরে ফেলি।

10323071_10151758833482614_621609043_n
সেই প্রচ্ছন্ন বিকেলে অনেকেই এসেছিল জয়াকে দেখতে, তাকে কিছুক্ষন সংগ দেয়ার জন্য। কিন্তু সবাই বেশ অবাক হয়েছে যে এর মাঝে আমি বারবিকিউ এর ব্যাবস্থা করেছি। সেই সন্ধ্যার স্মৃতি আজও মনে আছে আমার। সন্ধ্যায় আমরা যখন লনে বসে বারকিকিউ করছিলাম তখন বারান্দা থেকে তুমি বার বার আমাকে এটা ওটা নির্দেশ দিচ্ছিলে যাতে আমি বারবিকিউ গুলি নষ্ট না করে ফেলি। যদিও জারা আমাকে সাহায্য করছে। “শোন এই লেটুস পাতা গুলিও হাল্কা ভেঁজে দেই আর কিছু সজ দিয়ে দেই। খেতে চমৎকার হবে বুঝলে” জারা বলল। আমি মাঝে মাঝে ধোঁয়া ওঠা কয়লার উনুন থেকে মুখ সরিয়ে তোমাকে দেখছিলাম। আধশোয়া ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে আমাদের দেখছিলে আর মাঝে মাঝে গল্প জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলে। নিক আর লুজান দুজন কিযেন গভীর বিষয় নিয়ে নিচু স্বরে নিজেদের মাঝে কথা বলে গেল প্রায় সারাক্ষন। এলিসিয়া, ভ্যানরিক, আর আজোয়াদ কি যেন একটা বিষয় নিয়ে কোনভাবেই একমত হতে পারছে না। তারা একটু পড় পরই চিৎকার করে হাসছে নয়ত এ ওকে গালি দিচ্ছে। কিছুক্ষন গল্প করে ফ্রেডরিক, লীনচ আর ডেমিয়েন পুলে নেমে গেল। লীনচ কিছুটা বেশি টেনে ফেলেছে মনে হয়। সে চিৎকার করেই যাচ্ছে। একবারতো তোমাকেই পানিতে নামতে বলল! আমি আর জারা বসে বসে বারবিকিউ বানাচ্ছি আর জারা সবাইকে অর্ডার মত পরিবেশন করছে। এরিনা একটু দেরি করে এসেছে সোজা অফিস থেকে। এরিনাকে অনেকদিন দেখিনি আমি। আসলে সে কিছুদিন এখানে থাকে আবার হুট করেই পিফ্লুইম এ চলে যায় তার স্বামীর কাছে। দুজনার কাজ দুই মেরুতে হওয়াতে বেশ ঝামেলাই পোহাতে হচ্ছে এরিনাকে। এসেই তোমার পাশে বসে কি যেন গল্প করেই যাচ্ছে একনাগাড়ে। একটু চোখা চখি হতেই একটু অপ্রতিভ হাসি খেলে যায় তার ঠোঁটে। কে জানে কোনও সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে নাত মেয়েটা! ভাল মানুষ সে আর খুব আবেগ প্রবন। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। তার বিয়ের দিনটার কথা আজও মনে পড়ে আমার। পিফ্লুইম চলে যাচ্ছে স্বামীর সাথে। জাওয়ার আগে আমাদের কাছ থেকে অশ্রু ভেজা বিদায় নিলো। আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তার মুহূর্তের কান্না আমাদেরকে বেশ বিহ্বল করে দিয়েছিল। আমাদের দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলেছিল আর ফিস ফিস করে বলেছিল “অনেক মনে পড়বে তোমাদের দুজনকে অনেক মিস করবো। খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই। ভাল থেক। জয়াকে দেখে রেখ সবসময়”

সে রাতে লীনচ, ফ্রেডরিক ার আজোয়াদ থেকে গেল এখানে। আমরা সবাই আবার রাত জেগে আড্ডা দিলাম আর কিছু ডকুমেন্টারি দেখলাম। এগুলি লীনচ এর এখনকার করা কাজ। লীনচ নতুন কি যেন একটা প্রজেক্ট এর কাজে হাত দিয়েছে বলেছিল। এগুলি তারই ক্লিপিংস। আমি বেশিক্ষন আর টিকতে পারিনি। একটু ঘুম লেগে আসছিল। আমি শোবার ঘরে ফিরে দেখি তুমি গুটি শুটি দিয়ে ঘুমিয়ে আছ। ঘুমে এতটুকু হয়ে যাওয়া তোমার ক্ষীন শরীরটাকে আমার কাছে টেনে নিয়ে কখন ঘুমিয়ে যেন গেছি।

Share your thoughts