খড়ের বাড়ি

সময়টা কখন তা মনে পড়ছে না সঠিক ভাবে। হতে পারে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালের দিকের কথা। আমরা তখন বরিশালেই থাকা শুরু করেছি। শহর থেকে ছুটি পেলেই মা আমাদের কে নিয়ে দাদা বাড়ি অথবা নানা বাড়ি নিয়ে জেত বেড়াতে। ঈদ আর কোরবানির উৎসব গুলি ওখানেই করা হত সেই দিন গুলিতে। আমরা তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতাম কখন আমাদের কে নিয়ে গ্রামে জাওয়া হবে। যেদিন আমরা যাত্রা করতাম তার আগের রাতে অনেক প্রস্তুতি থাকতো আমাদের। কোন জামা গুলি জুতা গুলি নিতে হবে তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা আর গোছগাছ থাকতো। মনে মনে অনেক খেলার ছক আঁকতাম। মনের আকাশ স্বচ্ছ শরতের মত ছিল। কি এক বিশাল আনন্দ এসে ভর করতো ছোট হৃদয়টায়। দাদা বাড়ি গেলেই একটা দল জুটে জেত। দক্ষিণের মাঠ, পুবের বাগান, আর উত্তরের মাঠে এক সুবিশাল রাজত্বে আমরা হারিয়ে যেতাম। মনে হোত এই সম্রাজ্যের হয়তো কোথাও সীমানা দেয়া নেই।

সেবার শীতে আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম আমরা একটা খড়ের বাড়ি বানাবো। আমরা সেটার ভেতরে থাকবো। সেটার পাশে বাগান বানাবো আর সামনে একটা উঠান বানাবো। একদিন খড়ের বাড়িতে চড়ুইভাতির ব্যাবস্থাও হবে। আমরা সবাই সোৎসাহে রাজি হওয়ে গেলাম। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে বেশ খানিকটা খড় জোগাড় করতে হবে। সেটা সহজ নয়। প্রসাদ বানানো কখনোই সহজ ছিল না। স্বপ্ন পূরনের থেকে কঠিন আর কিছুই নেই। আমরা সবাই যে যার বাড়ি থেকে খড় জোগাড় করবো শিধান্ত নিলাম। প্রতিদিন আমরা একটু একটু করে খড় লুকিয়ে নিয়ে এসে জড় করতাম দক্ষিণের বাগানের পুরনো কবরস্থানের পাশে। ওই দিকটায় সচারাচর কেউ যায় না। খড় এনে আমরা কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখতাম। মনে হয় সব থেকে বেশি খড় আমি জোগাড় করে ছিলাম। উৎসাহটা বোধহয় আমরই বেশি ছিল।

এক দুপুর গড়ানো চমৎকার দিনে আমরা আমাদের খড়ের বাড়ি বানানো শুরু করি। আমাদের মাঝে এই কাজ করার এক্সপার্ট ও ছিল। লিটন আগেও খড়ের বাড়ি বানিয়েছে। সে গ্রামেই থাকে। তার অভিজ্ঞতা অনেক। আমরা তার নেতৃত্বেই কাজ করছি। বাঁশ ঝাড় থেকে কঞ্চি জোগাড় করা হোল ছাউনি বানানো জন্য। লাকড়ির কাঠ দিয়ে চৌকাঠ বানানো হোল। মাটি সমান করে পানি দিয়ে লেপে দেওয়া হোল মেঝে বানানোর জন্য। দুই একজনের উৎসাহ ভাঁটা পরলো। তাদের কাছে এই খেলাটা নতুন নয়। বছরে তারা দুই একবার এমন বাড়ি বানায়। তারা বরং নির্দেশনা দেয়া আর নানা রকম আকডুম বাকডুম গল্প ফাঁদায় ব্যাস্ত ছিল। স্বজন আমার থেকে বয়সে কিছুটা বড় আর সম্পর্কে আমার চাচা হলেও সে আমার বন্ধু স্থানীয় বলতে গেলে। পৃথিবীর সব চমৎকার গালি আর বুদ্ধিদীপ্ত কোথা বার্তা তার দখলে ছিল। সে হটাত কোত্থেকে এসে আমাদের এই ব্যাপার গুলি নিয়ে এক চোট হাসি তামাশা শুরু করে দিত। আমরা কতোটা আনাড়ি এইসব কাজে, সে নানা ভাবে আমাদের এক হাত বুঝিয়ে দিত। সাথে তার তির্যক কিছু কথা ও গালি। আর কেউ উপভোগ না করলেও আমি তার এই চমকপ্রদ সব শব্দ শৈলীর বিশেষ অনুরাগী ছিলাম। সে আমাদের কে দূরে দাঁড়িয়ে কিছু উপদেশ ও ভতসনা দিয়ে কোন একদিকে চলে জেত। সে এমনি ছিল সবসময়। তবে আমি তাকে বিশেষ পছন্দ করতাম তার নানান বুদ্ধিমত্তার কারনে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আমাদের বাড়ি বানানো শেষ। কাদার মেঝে এখনো ভেজা। সুন্দর গোলাকার ছাউনি দেয়া একটা ঘর। ভেতরে কিছু শুকনো খড় বিছিয়ে দিতে হবে। আর পাশে কিছু বাগান করতে হবে আগামীকাল। কি একটা জংলি ফুলের গাছ পাওয়া জেত। লাল একটা ফুল ফুটতো লম্বা সবুজ নলচে কাণ্ড জুড়ে। ওটাই গোরা শুদ্ধ তুলে এনে চারদিকে বসিয়ে দিতাম। কুয়াশা থেকে বাঁচানোর জন্য ঘরের চালাটা আপাতত কলা পাতা দিয়ে ঢেকে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। সারা রাত কাটল উত্তেজনা। দাদাকে অবশ্যই এটা কাল সকালে দেখাতে হবে। দাদা একটু কপট রাগ দেখিয়ে প্রশংসা শুরু করে দিবে। গায়ে কাদা লাগিয়ে খেলা তার অপছন্দ। খড় যে তার খড়ের গাদা থেকেই গেছে সেটা তাকে বিচলিত করবে নিশ্চিত। এরকম নানান অপছন্দের বিষয় নিয়ে একগাদা কথাও শুনতে হবে। কিন্তু আমি জানি ঘরটা দাদার পছন্দ হবেই। সে একটা তাছিল্লের হাসি দিয়ে খোলা মাঠের আইল বড়া বড় হেঁটে পুবের দিকের ক্ষেতে চলে যাবে। আবার একটু দূর থেকে কি মনে করে গলা বাড়িয়ে বলবে রোঁদের মধ্যে টো টো না করে যেন তাড়াতাড়ি ঘরে চলে যাই।

তিরতিরে শিতের রোদ আলতো হয়ে শরীরে বেয়ে যায়। পাকা ধানের ক্ষেতে এখনো কুয়াশার রেশ লেগে আছে। সবাই আস্তে আস্তে জড় হয়। একটা চড়ুইভাতির আয়োজন নিয়ে আমরা ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। বিকেলেই চড়ুইভাতি। সব পরিকল্পনা আমাদের হলেও রান্নার ব্যাবস্থা আর জিনিসপাতির আয়োজন এর জন্য সেই ফুপুদের কাছেই জেতে হয়। প্রথমে ভেটো দিবেই। পরে সব কর্তিত্ব তাদের হাতে নিয়ে নানান শর্ত বেঁধে দিয়ে একটা চড়ুইভাতির ব্যাবস্থা করে দিত। সন্ধ্যা নেমে আসতো আমরা ইট আর কাঁদা দিয়ে বানানো চুল্লির চারপাশে গোল হয়ে বসে রান্না দেখতাম। একটা চুলায় প্রতিযোগিতা করে শুকনা খড় আর লাকড়ি গুঁজে দিতাম। দাউ দাউ করে আগুণ জ্বলত। রান্নার তদারকিতে থাকা চাচা কিংবা ফুপুরা একদফা বকা দিত। তবুও আমরা আমাদের কর্তিত্ব জারি রাখতাম। কারন তারা বাবুর্চি হলেও আমরাই এই বনভোজনের আয়োজক। আমরাই যেন প্রধান সঞ্চালক। গনগনে লালচে আগুনটাকে চারপাশের নিকষ অন্ধকার যেন গ্রাস করে ফেলতে চায়। আগুণের বাইরে দৃষ্টি গেলেই গা ছম ছম করতো। আমার পৃথিবীটা তখন আটকে জেত সেই ছোট্ট আগুণের কুন্ডুলিতে। তখনো জানিনি সময়ের গল্পে এই মুহূর্তের আবর্তন হবে না আর। তখনো জানিনি এই শিতের রাতের অন্ধকারে আর কোন গল্প থাকবে না। সময় যেন কুয়াশার মত পড়তে পড়তে চাদর বিছিয়ে এই গল্পগুলি কোথায় লুকিয়ে ফেলেছে। আমার হৃদয়টাকে এই ছোট খালের পাড়ে ধানক্ষেত লাগোয়া বড় রাস্তার পাশে বেঁধে দিয়ে সময় তার আবর্তে হারিয়ে গেছে।

১৮ জুলাই, ২০১৭
টরন্টো, ইউনিভার্সিটি এভিনিউ

Share your thoughts