েফলে আসা শৈশব খণ্ড ঃ ৬ (টিনটিন আর ফাহিমের কথা)

আমার ছেলেবেলাটা কেটে গেছে স্কুল বদলাতে বদলাতে। ২-১ বছর পর পরই স্কুল পরিবর্তন করে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়া। ১৯৯৬ সালে যখন ঢাকায় চলে আসি মায়ের সাথে, ফেলে আসি শৈশবের প্রিয় বরিশাল জিলা স্কুল। অনেক স্মৃতি আর অনেক ছেলেবেলার বন্ধু। সব ফেলে ঢাকার পথ ধরি। মন খারাপ হয়েছিল আবার সেটা উবেও গিয়েছিল কোন একটা বিশেষ অনুভূতিতে। তখনকার সে অনুভূতি এখন আর বিশেষ কোনও রেখাপাত করে না। সে সময় যখন ঢাকা বেড়াতে আসতাম তখন ঢাকাকে বেশ ভাল লাগত। প্রচণ্ড প্রাণবন্ত ব্যাস্ততা আর নতুনত্বের ছড়া ছড়ি। বিশাল শহর, অনেক বড় রাস্তা আর রাস্তা জুড়ে অনেক রিক্সা, গাড়ি, বাস। এখানে আমার মামারা সবাই থাকে। যেকোনো সময় মামাদের বাসায় বেড়াতে যেতে পারব সেটাও একটা বিশেষ আনন্দের কারন ছিল হয়তো। যে সব কারনে বরিশাল ছেড়ে আসতে আমার মন খারাপ হচ্ছিল তার মধ্যে সব থেকে অন্যতম ছিল আমার পালিত মুরগি গুলি। আমার ২-৩ টা মুরগি ছিল, যেগুলি ছেড়ে আসতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল আর আমি কেঁদেও ছিলাম। ভয়াবহ বীভৎসতা আমার মনকে নাড়া দিয়ে যায়। আমরা চলে আসার ঠিক আগের দিন আমার সাদা রঙয়ের মুরগিটাকে কেউ পেটে ছুরি বিঁধিয়ে দেয়। এই কাজটা কে করেছিল জানতে পারিনি আর। দোতলায় সিঁড়ির পাশে মুরগির খোপের সামনে আর আম্মার ঘরের মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে কারন অনুসন্ধান করতেই বেড়িয়ে পড়ে খাটের নিচে সাদা মুরগিটা ঝিম মেরে বসে আছে আলুর টুকরির উপড়ে। সাদা পালকে রক্তের ছোপ, টুকরির আলু গুলিও রক্তে মাখামাখি।সেই স্মৃতি আজও যখন আমার মনে পড়ে, আমার মন ভেঙ্গে যায়।

মন খারাপ হয়েছিল পুকুরে আর সাঁতার কাটা হবে না ভেবে। আর বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলা হবে না। স্কুল ছুটির দিনে দিক্বিদিক মাঠে ঘাটে ঘোরা হবে না। পরেশ সাগর, মেডিকেল কলেজ ের মাঠ, বেইলস পার্ক, সাত গোডাউন কোথাও আর যাওয়া হবে না। ছাদের কোনায় লাগানো গাছ গুলিও হয়তো মরে যাবে অথবা কেউ উপড়ে ফেলে দিবে। আমার শখের বাগান ! আহা! অথচ একটা বিশেষ কারনে খুব বিপদ মুক্তির আনন্দ অনুভব করছিলাম তখন। প্রাইভেট টিউটর বিদ্যুৎ স্যার আর আমাকে সন্ধ্যায় স্কেল দিয়ে নির্দয় ভাবে পেটাবে না। স্কুল জীবনের একটা দুঃখজনক ঘটনা বলি। হয়ত এরকম দু একটা স্মৃতি সবারই থাকে। ঠিক দুঃখজনক না। আমার জন্য কিছুটা বিব্রতকর ছিল বৈকি।

আর সবার মত আমারও কমিক পড়ার নেশা ছিল। চাচা চৌধুরীম, ফ্যান্টম, টিনটিন,  আর্চিস সহ যাবতীয় কমিক্স এর প্রতি ছিল বিশেষ আকর্ষণ। স্কুলে আমরা বন্ধুরা মিলে কমিক্স কালেকশন করতাম আর সবাই শেগুলি শেয়ার করে পড়তাম। ফাহিম নামের আমার এক বন্ধু ছিল। ফাহিম এর শারীরিক গঠন এর কারনে আমরা তাকে কিছুটা সমীহ করতাম। তবে যে কারনে সব থেকে সমীহ করতাম তা হল, ফাহিমের বাবা বরিশাল পুলিশ এর প্রধান। ফাহিম একমাত্র ছেলে যাকে পুলিশের বিশেষ জিপ পুলিশ প্রহরায় স্কুলে আনা নেয়া করতো। বাবা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার কারনেই ফাহিমের একটু আহামরি হেঁয়ালিপনাও ছিল। সে আমাদের একরকম তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই করতো বলতে গেলে। শুধু একটা কারনে আমরা সবাই ফাহিমকে বেশ সমাদর করতাম। ফাহিমের কাছে যত কমিক এর কালেকশন আছে তা তাবৎ বরিশাল এর কোন বইয়ের দোকানেও নাই। ক্লাসে আমার আর ফাহিমের একটা মোটামুটি চলনসই বন্ধুত্ব তৈরি হয়। আমরা দু’জন কমিক শেয়ার করি। আমার কাছে যদিও তেমন কিছু ছিল না। ফাহিম এর শর্ত একটাই আমি যদি কোন কমিক পাই সেটা অবশ্যই ফাহিমকে আগে দেখাতে হবে। সে পড়ার পরেই আমি পড়তে পারবো। আর তার কাছ থেকে কমিক নিয়ে পড়তে হলে তাকে ২ টাকা দিতে হবে।এই শর্ত মানলেই সে তার কমিক সম্রাজ্যের ভাগ আমাকে দেবে। তার দাবিই তথাস্ত। আমি প্রায় প্রতিদিন ফাহিম এর সাথে পুলিশের বিশেষ গাড়িতে করে টিফিন পিরিয়ডে তার বাসায় যেতাম। জীবনে প্রথম এমন কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঢোকা। ছবির মত সুন্দর বাড়ি। চারপাশে ফুলের বাগান আর গাছের ছায়া ঘেরা। পাশে বিশাল পুকুর। এই কম্পাইন্ডের মাঝে ঢুকলেই আমি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম। ফাহিমের রুমটা ছিল যেন এক কমিকের ডিসপ্লে সেন্টার। আমি প্রতিদিনই কমিক নিয়ে এসে পড়তাম। আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল ফাহিমের টিন টিন কালেকশনের উপড়ে। টিনটিনের প্রায় সব কালেকশন আমি তার কাছে থেকে নিয়ে পড়েছি। বিপত্তিটা এখানেই বাঁধে। টিনটিনের একটা বইয়ের পেছনের মলাট আমি ছিঁড়ে ফেলি। ঘটনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপার ফাহিমকে কোনভাবেই জানানো যাবে না। সে ছেঁড়া বই মেনে নিবে না। তার থেকে ভয়াবহ ব্যাপার সে আমাকে আর তার কমিক পড়তেও দিবে না। সে যে পরিমাণ দুষ্ট দস্যু প্রকৃতির এমন কি সে আমাকে স্কুলে মারতেও পারে। আমি মোটামুটি আতঙ্কেই পড়ে গেলাম। তখন একটা বইয়ের দাম প্রায় ১১০-১২০ টাকা। আম্মাকেও এই ব্যাপারে বলা যাবে না। কারন কমিক একটি নিষিদ্ধ বই। আর সেই বই ছিঁড়ে এতগুলি অর্থ ডুন্ডি দেয়ার প্রশ্নই আসে না। ফাহিম বই ফেরত চায়। আমি প্রতিদিন দেব দিচ্ছি করে  নানা বাহানায় কাটিয়ে নেই। ওই সময়টায় আমি রীতিমত আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ি একটা সাধারণ কমিক বইয়ের জন্য। স্কুলে জানলে বিপদ বাসায় জানলে বিপদ এর মধ্যে ফাহিম আরেক বিভীষিকা। সে আমাকে তার বাবার ভয়ও দেখিয়ে দিল রীতিমত। আমি তাকে আমার প্রিয় ফ্যান্টমের সব কালেকশন দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব ও দেই। সে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার ভাব করে বলে তার কাছে ফ্যান্টমের সব বই আছে।

এর মাঝে ছোট মামা একদিন বাসায় বেড়াতে আসলো। এই সুযোগ। মামাকে টিনটিনের বই কিনে দেয়ার জন্য ধরলাম। আম্মার বিশেষ নির্দেশ, কোন কমিক কেনা যাবে না বরং কলম খাতা কিনো। মামা ৪৫ টাকা দিয়ে একটা পাইলট কলম কিনে দিলো ! স্কুলে যেতেও উৎসাহ নাই আর। ঠিক এমনই একটা সময়ে আমাদের পরিবার একটা বড় সিধান্ত নেয়। তখন সেই সিধান্তটি ছিল আমার কাছে পৃথিবীর সব থেকে আনন্দের খবর। অনেক কাঙ্ক্ষিত। ঢাকা থেকে গ্রিন সিগন্যাল আসে। আব্বা আমাদের যত ধ্রুত সম্ভব ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলে। তারমানে আমরা এইবার আব্বার কাছে ঢাকায় স্থায়ী ভাবে চলে যাব! আম্মা ধ্রুত সব গোছগাছ শুরু করে। আমরা দুই ভাই বন মহা উৎসাহে সেই গুছগাছে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। কোনটা কোন বক্সে যাবে? আমাদের বই খাতা কোন বক্সে যাবে? আমার জুতা কই থাকবে ? ফুটবল, ফ্রিসবি চাক্তি আর শটপুট গোলোক  কিভাবে নেব এইসব প্রায় অযাচিত ব্যাপার নিয়ে আম্মার পিছে পিছে ঘুরতে থাকি। যার সাথেই দেখা হয় তাকেই প্রবল উৎসাহে ঢাকা চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বলি। আমার অবাক লাগে, আমরা ঢাকা চলে যাচ্ছি এই ব্যাপারটাতেও সবাই খুশি। আমি ভাবতাম সবাই মন খারাপ করে আমাকে সান্ত্বনা দেবে ! সবাই বলে খুব ভালো হবে তোমরা এবার তোমাদের বাবার কাছে থাকবে। ঢাকায় আরও ভালো স্কুলে পড়াশুনা করতে পারবা। আমার কেন জানি প্রচণ্ড আনন্দ পেতাম এই ব্যাপারগুলির মাঝে। যাইহোক এরই মাঝে একদিন বুকশেলফ গোছাতে যেয়ে সেই ছেঁড়া টিনটিনের কমিকটি চোখে পড়ে। হটাত একটা বিশাল পাষাণ বুক বেয়ে নেমে যায়। ফাহিমকে আর ছেঁড়া বইয়ের ব্যাপারে কৈফিয়ত দিতে হবে না। ফাহিম আমাকে তার কমিক ছেঁড়ার জন্য মারতে পারবে না এমনকি স্কুলে নালিশ ও দিতে পারবে না। আমিতো আর থাকবই না এই শহরে আগামী  হপ্তা থেকে। আব্বা ঢাকা থেকে ট্রাক ঠিক করে পাঠিয়ে দেয়ার দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলেছে। হাতে মাত্র আর কয়েকটা দিন।

আসলে আজ এইসব স্মৃতিগুলি মনে পড়লে মন খারাপ হয়। এত প্রিয় শহর, খেলার মাঠ, পরিচিত মানুষ ফেলে কেমন স্বার্থপরের মত ঢাকা যাওয়ার আনন্দে দিন গুনতে ছিলাম। হয়ত ওই ছেঁড়া কমিক বইটাই একটা আতঙ্ক ছিল যেটা থেকে মুক্তি খুঁজতে ছিলাম। কৈশোরের হৃদয় তখন হয়ত এইসব ক্ষুদ্র ভাবনা চিন্তার মাঝেই আলো  আন্ধকারের অনেক অলি গলিতে ঘুরত। ফাহিমের এই ঘটনাটা হয়তো অতি কৈশোরের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আজ এখানে দাঁড়িয়ে অনেক শুন্যতায় বন্ধু ফাহিমকে মাঝে মাঝে খুঁজি। হয়ত জড়িয়ে ধরে বলতাম “বন্ধু তোকে না বলেই চলে এসেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দে” বরিশাল জিলা স্কুলের সেই বন্ধুদের বেশিরভাগের সাথেই আমার আর যোগাযোগ নেই। জানি না কে কোথায় আছে। আজ আমাকে দেখলে কেউ চিনবে কিনা সেটাও শক্ত করে দাবি করতে পারি না। ক্লাসের আনাড়ি টাইপের অনুল্লেখ্য মেধার ছেলেটিকে কেউ মনে রাখবে এমন ধারনা আমি করিনা। নাহিদ, সাদ্দাম, জনি, রনি, মেহেদি, তমাল, ফাহিম আরো কত নাম কত মুখ ! মাঝে মাঝে এইসব স্মৃতির মুখোমুখি হওয়ার থেকে হারিয়ে যাওয়া কোন এক বন্ধুর মুখোমুখি হওয়া বরং ঢের আনন্দের হত।

IMG_1365