ফেলে আসা শৈশব খণ্ডঃ ৪ “হলুদ বাড়ি”

বরিশাল শহরটার ধরনটাই একটু নিরিবিলি আর শান্ত। এখানে খুব বেশি একটা ভীড় বাট্টা লেগে থাকেনা পথ ঘাট জুড়ে। কোথাও তীব্র জনস্রোত নেই, নেই কোনো যানজট বা শব্দ দূষণ । কিছু মানুষ কে সারাদিনই ঘুরে ফিরে পথে ঘটে দেখা যাবে। চেনা পরিচিত মানুষের শহর যেন। সবকিছুই যেন একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডির মাঝে নির্ঝনঝাটে কেটে যায়। শহরটাতে পুরনো বাড়িই বেশি, তবে এখন অনেক নতুন বহুতল বাড়ি দেখা যায় সর্বত্রই।

বরিশাল এ আমরা যে বাড়িতে থাকতাম সেটা শতাব্দী প্রাচীন একটি ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। বাড়িটির আসল উৎপত্তি সম্পর্কে কেন জানি জানা হয়নি কখনই। কিন্তু এটা অনুমান করতে পারি যে বাড়িটির প্রকৃত নির্মাতা ও মালিক ছিল বনেদী কোনো হিন্দু পরিবার। কারণ বাড়ির অভ্যন্তরীণ ও বাহি‍্যক  নকশা সেই নিদর্শনই বহন করে। মূল বাড়িটি একতলা। এর ভেতরে একটি প্রধান বৈঠকখানা সহ বেশ কিছু কক্ষ রয়েছে। বাড়িটি বর্তমানে একটি মুসলিম পরিবারের মালিকানাধীন। বহু বছর পূর্বে হাত বদল হয়ে আসার ফলে এখন বাড়িটির অভ্যন্তরীণ আসল নকশা ও স্থাপনা বহুলাংশেই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বৈঠক খানার মেঝেতে এখনো বেশ সৌখিন পাথর ও মোজাইক এর কাজ বিদ্যমান আছে।

এই গেল মূল বাড়ির পরিচয় যেখানে আমাদের বাড়িওয়ালা তার পরিবার সহ থাকতেন। এবার আমাদের থাকার অংশের পরিচয়ের পালা ….

মূল বাড়িটি সরাসরি প্রধান সড়কের সাথে সংযুক্ত থাকলেও আমরা যে অংশে থাকতাম সেটা ছিল মূলবাড়ির পেছনের একটি বর্ধিত দোতলা পরিসর। আমার ধারণা এই অংশটি ছিল অতিথিশালা ও বাড়ির পরিচারকদের থাকার স্থান। মূল বাড়ির সামনে থেকে পেছনের ওই অংশটি দেখা যায় না।  আমরা আমাদের বাসায় যেতাম পেছনের একটু ঘোরা পথে। পেছনের এই অংশে একচিলতে উঠোনের মত জায়গা আছে যেখানে মাঝবরাবর একটা বিশালাকার ঝাকরা মিষ্টি বড়ই গাছ আর একটা পানির ডিপটিইবয়েল। বড়ই গাছের একটা অংশ এসে ঢেকে দিত আমাদের দোতলার বারান্দা। ঠিক পশ্চিম পাশে একটা লাগোয়া পুকুর আছে, আরেকটা পুকুর আছে উত্তর পাশে। যেখানে যেতে সামান্য এক চিলতে ইট বাঁধানো পথ পাড়ি দিতে হতো। এই পথের দুই ধারেই নানা রকম ফলের বাগান ছিল। চালতা, নারিকেল আর পেয়ারা গাছ গুলির কথা আজও মনে আছে।

বাড়িটির যে দোতলা অংশে আমরা ভাড়া থাকতাম তার নিচতলায় থাকত আরেকটি ভাড়াটিয়া পরিবার। দোতলায় যাবার জন্য ছিল একটি প্রায় শতাব্দী প্রাচীন কাঠের সিড়ি। যে সিড়িটি সেসময়ে আমাদের কলিংবেল এর কাজ করত। বাড়িতে কেউ আসলে সিড়িতে পায়ের স্পষ্ট শব্দ পেতাম। মাঝে মাঝে বিশেষ কোন মানুষের আগমন সিড়িতে পায়ের শব্দ শুনেই বুঝে যেতাম। সব থেকে উত্তেজনায় ভুগতাম যখন ভোর রাতে সিড়িতে কারো পায়ের শব্দ শুনতাম। তখন হয়ত ঢাকা থেকে আব্বা আসত অথবা কখনো মামারা আসত। আমাদের দোতলায় মোট রুম ছিল ৩ টি, যার মাঝে দুটো আমরা শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতাম আর আরেকটা ছিল একসাথে রান্না ও খাবার ঘর। ঘরের সিড়ির পাশেই ছিল রেলিং দিয়া টানা বারান্দা যার একটি অংশ বাড়ির একতলা মূল অংশের বর্ধিত অংশের  সাথে মিশেছে। ওই অংশটা ছিল আমাদের কাছে বেবিলন এর শূন্যউদ্যান। রেলিং এর ভাঙ্গা অংশের ফাক গলে চলে যেতাম   শূন্যউদ্যানে। ঠিক এখান থেকেই আরেকটা পলকা সিড়ি বেয়ে আমরা উঠে যেতাম মূল বাড়ির বিশাল ছাদের উপর (ছাদের উপরে যাওয়া ছিল চরম দণ্ডনীয় অপরাধ, যদিও এই অপরাধ আমরা সানন্দেই করে যেতাম)। এই আশ্চর্য শূন্য উদ্যান এর নামের সর্তকতার জন্যই কিনা জানিনা এখানে সরা সরি মাটির স্তুপ করে তার উপরে কিছু গাছ লাগানো হয়েছিল। গাছের তালিকাটি ছিল এরকম বেগুন, গাঁদা ফুল, রেইনট্রি গাছের চাড়া, টমাটো গাছ, পুঁই শাক আর লাউ অথবা কুমড়ার মত কিছু একটা লতানো গাছ। আমাদের কাজ ছিল ওই গাছ গুলিতে সকালে ও বিকেলে অজস্র পানি দেয়া। পানি দিলেই কিছু পানি গড়িয়ে নিচে পড়ত। সেটা যদি নিচের কেউ দেখে ফেলত তাহলেই এক চোট বকা ঝকা করে দিত অতিরিক্ত পানি দিয়ে ছাদ সারাক্ষণ ভিজিয়ে রাখার জন্য। খুবই অবাঞ্চিত ও অন‍্যায় আচরণ। পরে আমি কয়েকটা গোলাপ এর চাড়াও লাগিয়েছিলাম। চমৎকার ফুলও ফুটত গাছগুলিতে। বৃক্ষ শ্রেনীর প্রতি ভালবাসার ব‍্যাপারটা হয়ত এখান থেকেই।

বাড়ির সামনে ছিল হৃদয় আকৃতির একটা বড় মাঠ। বাস্তবিক অর্থেই মাঠের দুইধারের চক্রাকার রাস্তার নকশা মাঠটিকে যেন হৃদয়ের মত আকৃতি দিয়েছিল। মাঠের পাশ ঘেঁষে সার বেঁধে লাগানো ছিল বিশাল আকৃতির অনেক গুলি পাম গাছ। পাম গাছের ফুল ঝড়ার মৌসুমে আমি প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতাম পাম গাছের নিচে। দক্ষিনের বাতাসে তুষার কনার মত ক্ষুদ্র পাম ফুল গুলি যখন ঝড়ে পড়ত তখন খুবই অবাক হতাম। ঝড়া ফুলে কংক্রিটের রাস্তা সাদা হয়ে যেত। আমি আনমনে তািকয়ে থাকতাম। দূর থেকে কেউ হয়ত ডাকত ঘর থেকে ফুটবলটা নিয়ে আসার জন্য। বিকেল যে তখন গড়িয়ে যায় …..