সোমেশ্বরীর বাঁকে
এই গ্রীষ্মের বাতাসে একটা ভারী ব্যাস্ততার রেশ চারদিকে। আমরা ঠিক কোথায় এসেছি জানি না। একটানা প্রায় ২০-৩০ কিলো হবে হয়তো পেছনের পথের দূরত্ব। আশিক একটা সিগারেট ধরিয়েছে। পেছনে নীলচে কালো আকাশের বুকে মাঝারি সাইজের একটা পূর্ণ চাঁদ। ৩৭০৪ নাম্বার লোকাল ডিভিশনাল হাইওয়ের উপর সদ্য নির্মিত একটা প্রশস্ত কাল্ভারট ব্রিজের উপর বসে আছি। মাঝে মাঝে দু’চারটা হিউম্যান হলার যাচ্ছে যাত্রী বোঝাই। আর দুর্দান্ত গতিতে ধেয়ে যাচ্ছে মালবাহী ট্রাক গুলি। এর কোনটায় খনিজ আকরিক, বালু, পাথর কিংবা মাছের পোনা। দুইজন দুই দিকে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে মূত্র বিয়োগ করে কিছুটা আলস্যে বসে আছি। প্রাকৃতিক পরবিশে এখানে বেশ মনোরম। তবে হাইওয়ের একেবারে ধার ঘেঁষে বসে থাকার জন্য নিরবিচ্ছিন নিস্তব্ধতা উপভোগ করা যাচ্ছে না। বৈশাখের শেষ প্রায়। আচমকা আবহাওয়া বদলে যায়। তারই আভাস যেন আকাশেও। ধূসর রঙের ফিন ফিনে মেঘ উত্তরে ভেসে যাচ্ছে। কখনো কখনো চাঁদটা ঢেকে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়ের জন্য। অন্ধকারে কিভাবে নিজেদের একটা ছবি তোলা যায় তার কসরত করলাম দুজন মিলে কিছুক্ষণ। মাথায় একটা ভাবনা তাড়া দিচ্ছে। এই অচেনা প্রান্তরে যদি এখন একটা ঝুম বৃষ্টি নেমে পড়ে তাহলে বেশ বেগ পেতে হবে সন্দেহ নাই। আশ্রয় খোঁজাও হবে আরেক হ্যাপা। একেবারে অচেনা রাস্তা লোকালয় কাছে দূরে কোথাও নাই। মোটামুটি গুগল ম্যাপ ধরে ধরে আগাচ্ছি। ঠিক আজ সকালেই এরকম এক খামখেয়ালী বৃষ্টির তাণ্ডবে পড়ে প্রায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে যাত্রা শুরু করেছিলাম শেরপুর শহর থেকে।
শেরপুরে সকালে ঘুম থেকে উঠে বেশ ভালো লেগেছিল। গতকাল রাতে আমরা এই হোটেলে যখন উঠেছিলাম তখন ক্লান্তিতে কোন কিছু বুঝে উঠেতে পারিনি। আশিক এখনো ঘুমাচ্ছে আমি বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালাম। আকাশ তখনো পরিষ্কার ছিল। চমৎকার ভোর। শুক্রবার এই শহর এখনো জেগে উঠেনি। বারান্দা থেকে সবকিছু ভালো দেখা যায় না। সামনে এক সারি বাড়িঘর। রাস্তার খানিকটা আর বন্ধ দোকানপাটের কিছু দেখা যায়। এমনকি আকাশটাও একপাশ বন্ধ। একটা কুকুর কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারও বুঝি আজ ছুটি। কদাচ দুই একটা রিক্সা যাচ্ছে। এ শহর বিভোর শান্ত ঘুমে। আমরা হোটেল ছাড়লাম একটু আলসেমিতে দেরি করেই। চা পান এর জন্য আমরা একটা টং দোকানে ভিড়ে গেলাম। নাস্তা করবো পথে কোথাও। আমরা আজকের গন্তব্য ঠিক করছিলাম বসে বসে। আশিক এর টেলিটক এ গুগল ঠিকই কাজ করছে আমার টেলিটক যথারীতি মাকালফল। প্রথমে ঠিক করলাম এখান থেকে আমরা জামালপুর কালিহাতি হয়ে ঢাকায় ফিরবো। পড়ে আবার শিধান্ত পরিবর্তন! আমরা দুর্গাপুর বিড়িশিড়ী যাব। মোটামুটি একটা খসড়া ম্যাপ কপি করলাম। এই পথে আমাদের পেরুতে হবে নলিতাবারি ও হালুয়াঘাট। রাস্তার অবস্থা আমাদের কারো জানা নেই! কিন্তু ভয় নেই। এই যাত্রার কোন সময় বাঁধা নেই। তাই ইচ্ছেমত নিরুদ্দেশ হোলেও এই মুহূর্তে খুব বেশি লাভ ক্ষতির হিসেব আঁটা যাবে না। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কম দুধ দেয়া ঘোলাটে চায়ের মত মাথার উপরে সকালের ঝকঝকে আকাশ বিবর্ণ পাংশুটে হয়ে গেলো। আকাশের হাতে সময় নেই। এই ছোট শহরে তাঁর আজ বৃষ্টির আয়োজন। আমি বেশ ভড়কে গিয়ে আশিক কে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে আমরা যাবো কিভাবে বৃষ্টি নামলে ? সহজ উত্তর তোর ভিজতে সমস্যা আছে ? আমার ব্যাগে ক্যামেরা ! একটা রেইন কোট এর ব্যাবস্থা করতে হবে। সাথে সাথে রেইন কোটের খোঁজে বেড়িয়ে পড়লাম দুজন। ঘড়িতে দশটা বাজে কি বাজে নাই। দোকানপাট খুলে নাই এখনো। একটা মার্কেট এর সামনে দাঁড়ালাম। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। বাইক থেকে নামতে না নামতেই বৃষ্টির আক্রোশে সবকিছু ভেসে গেলো। আহ! বৃষ্টি। আকাশে মেঘের রঙ আর বৃষ্টির দাপট দেখে আমি মোটামুটি ধরেই নিলাম ব্যাপারটা আর আনন্দময় থাকছে না। রেইন কোটের ব্যবস্থা হয় নাই। দোকান বন্ধ। একটা টানা কার্নিশের নিচে মোটামুটি তুমুল বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে দাঁড়িয়েছি। আশিক কখনোই সময় অপচয় করে না। সে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। সিগারেট টানতে টানতেই কোনদিকে জানি গেলো। বৃষ্টি থামার কিছুক্ষন পর ফিরল একটা রেইন কোট নিয়ে। মুখে ট্যারা হাসি।
বৃষ্টি থেমে গেছে। যতটা আয়োজন করে এসেছিল চলে গেলো ততটাই সহসাই। শেরপুর শহরে বৃষ্টি ভেজা উজ্জ্বল রৌদ্র জ্বলা সকাল। এমন সকাল তার রূপসী আহবানে বার বার বলছে থেকে যাও এখানটায়। রেইন কোট গায়ে চাপিয়ে বাইকে উঠে বসলাম। লোকমুখে রাস্তা বের করে নির্ধারিত পথে ছুটে চলছি দ্বিতীয় দিনের মত। ২-৫ মিনিটের মাঝের শহর, মফঃস্বল পেছনে ফেলে মসৃণ বৃষ্টি ধোয়া পিচ ঢালা পথে ছুটে চলছি। দুই পাশে ধানের ক্ষেত দিগন্তজোড়া। এই দীর্ঘ পথের প্রায় পুরোটাই একি দৃশ্যের সাথে ছায়া সমতল পথ চলা। প্রায় ঘন্টাখানেকের আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম নকলা বাজার। মফঃস্বলের বাজার। সকালের বৃষ্টি এখানেও ছাপ রেখে গেছে। চারদিকে পানি কাদা। আমরা নাশতা করতে বাজারের এক সরাইয়ে ঢুকে গেলাম। যে কোন এলাকায় গেলে অত্র অঞ্চলের মিষ্টি পরখকরাটা আমার পুরানো অভ্যাস। এখানে পেলাম চমৎকার দুধ মালাই চাপ আর রসগোল্লা। স্বাদ চমৎকার। এই শহর না পরের শহর থেকেই টাকা তুলে রাখবো। এভাবে ঊঠাব উঠাব করে আর ভেন্ডর মেশিন থেকে টাকা তোলা হয়নাই। আমাদের দুজনারই টাকা ফুরিয়ে গেছে। আমরা আয়োজন করে আমাদের মানিব্যাগগুলি তল্লাশি চালালাম। যা পাওয়া গেলো তা দিয়ে আমাদের দুপুর পাড় করা যাবে। এরই মাঝে কোথাও থেকে টাকা তুলে নিতে হবে। বেরিয়ে পড়লাম আবার। বিরিশিরি অনেক দূরের পথ এখনো।
এবার আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দেয়া হোল একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক প্রাচীন মেঠো পথে ধরে সোজা ! এই পথে ঢুকেই যে ব্যাপারটা মাথায় ঘুরতে থাকলো তা হোল এই পথ এর বয়স কত? এতোটা প্রশস্ত পথ অথচ এখানে কোন ইট সুরকির প্রলেপ পড়েনাই কেন ? আমার এই জীবনে আর যদি কোনদিন এই পথে ফিরেও আসি তখনো কি এভাবেই দেখতে পাবো এই প্রাচীন পথটাকে ? এটাই হয়তো এই অনিন্দ্য সুন্দর মেঠো পথে আমার শেষ যাত্রা! গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপ চারপাশে। বাতাস ও নেই। যতটা সম্ভব ঝুঁকি এড়িয়ে ধ্রুত পথ চলছি আমরা। শুনশান নীরবতার মাঝে আমাদের মোটর সাইকেলের শব্দ ছাড়া কিছু নেই। আমরা এসে থামলাম একটা খাট গাছের নিছে। চারপাশে ধানি জমি। মাঝ বরাবর এই উঁচু মেঠো পথ। উঁচু নিচু পথের ঝাঁকুনিতে আমরা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গেছি। গাছের ছায়ায় বসে আছি। আশিক সিগারেট শেষ করছে। তাকে অন্যমনস্ক লাগছে। আমি অবশ্য আশিকের এই অন্যমনস্ক ভাবটা কখনোই ধরতে পারি না। এরই মাঝে তার ফোন এসেছে। সে যথারীতি একটু দূরে দাঁড়িয়ে সতর্ক ও গম্ভীর ভাবে কি যেন কথা বলছে। আমি পথ ধরে একটা বেকারি ফেরিওয়ালা যাচ্ছে। আমার ছোট বেলায় দাদা বাড়িতে আমি এই রকম ফেরিওয়ালা দেখছিলাম। হুবহু একি অনুষঙ্গ ও সজ্জায় এই ফেরিওয়ালা চট করে আমার স্মৃতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। চলেই যাচ্ছিল আমি একটা হাঁক দিয়ে থামালাম। দুইটা বোন রুটি কিনে আমরা দুইজন খাচ্ছি ধাঁ ক্ষেতের পাশে বসে। পৃথিবীর এই প্রান্তে বসে আমি জীবন নিয়ে ভাবনায় জাল বুনছি। কি মনে করে যেন আশিক কে আমি একরকম খোঁচান শুরু করলাম। সে এতো গুরুত্বপূর্ণ কি আলোচনা করলো ফোনে ? ধুম করে আশিক যে ব্যাপারটা আমাকে জানালো আমি তার জন্য সত্যি বলতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। ঢাকা থেকে আমাদেরকে ধ্রুত ফেরার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। ঢাকায় পৌঁছানর পরেই আশিক এর বিয়ে!
এতোগুলি দিন ধরে আশিক কে চেনার কারনেই হয়তো এই বিশেষ খবরটা আমাকে খুব একটা চমকে দেয়নি। ব্যাপারটা হয়তো এভাবেই সাজানো ছিল। কোন অচেনা জনপদে হটাত করেই আমি জানবো আশিকের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আর আশিক খুব ভাবলেশহীন ভাবে গুগল ম্যাপ এ খুব গুরুত্বপূর্ণ শর্টকার্ট রাস্তা খুঁজবে মুখে একতা সিগারেট গুঁজে। আমিও মোটামুটি নির্ভুল তথ্য যেনেই কেন জানি কৌতূহল এর বশে নানান প্রশ্ন জুড়ে দিচ্ছি। যেমন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুই কি মেয়েটাকে দেখেছিস? হু! দেখছি। কই ? কিভাবে ? হাতিরঝিল এ দেখা হইছে। এতো নিরলিত উত্তর আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি ফোন করলাম আশিক এর বড়বোন কে। মোটামুটি তথ্য নির্ভুল। ঢাকা ফিরতেই হচ্ছে তাহলে ধ্রুত। ঘটনার আকর্ষিকতা সবকিছু ক্যামন জানি খাপ ছাড়া লাগতে শুরু করলো। আমরা বসে থাকলাম সেই বিরান পথের ধারে। দুই ভাই বোন বাবার সাথে কোথায় যেনে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটা শখ করে বিচিত্র ভাবে সেজেছে। দেখে বেশ ক্যানো জানি ভাল লাগলো।
আমরা প্রায় একটানা বাইক চালিয়ে নলিতাবাড়ী, হালুয়াঘাট পেড়িয়ে ধোবাউড়া পৌঁছে গেলাম। ধোবাউড়া থেকে পথ চিনে চিনে আগাতে হচ্ছে। এখান থেকে সোমেশ্বরী নদী খুব দূরে নয়। আমরা যাচ্ছি সোমেশ্বরীর পাশের চীনা মাটির পাহাড়ে। বর্ষায় রাস্তা ঘাট এখানে বেশ খতিগ্রস্থ। একটা জায়গায় রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে। বাইক রীতিমত নৌকায় তুলে পাড় হয়ে হোল। মেঘ ডাকা বিকেল আর ঠাণ্ডা হয়ে আসা বাতাসে সোমেশ্বরী নদীর পাশ ঘেঁষে আমরা ছুটে চলছি। বর্ষায় গৃহস্থের উঠান কাদা পানিতে ভেসে গেছে। ধান ক্ষেত গুলি থৈ থৈ পানিতে তলিয়ে আছে। পাকা সড়কের উপর ধান শুকাচ্ছে সবাই। আর এই বিছান ধানের উপড় দিয়েই আমরা চলে যাচ্ছি। মাঝে একটা জায়গায় হটাত পাকা রাস্তাটি উধাও ! উধাও মানে একেবারেই উধাও। পানির স্রোতে বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে রাস্তা ধসে গেছে। বাইক নৌকায় করে পার করে তবেই আবার যাত্রা শুরু। এভাবেই আমরা পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশ এর চিনামাটির আকরিক আহরণের অন্যতম উৎস চীনা মাটির পাহাড়ে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া সেই বিখ্যাত নীল পানির হ্রদের পাড়ে। এখানে নীল পানির হ্রদ কই জিজ্ঞেস করতেই ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পেলাম। যার সারমর্ম এটাই সেই জায়গা। কিন্তু হ্রদতো নাই আছে টিলার মত উঁচু জায়গা। হ্যা এই টিলা গুলই চিনামাটির আকরিক এর পাহাড়। আর এর উপড়ে উঠলেই চোখে পড়বে হ্রদ। বেশ আডভেঞ্ছারাস মনে হচ্ছে। অনেকেই দল বেঁধে টিলায় উঠছে। আমরা টিলার নিছে কিচ্ছুক্ষণ বসে উপড়ে উঠে গেলাম। উপড়ে উঠে বেশ ভাল লাগলো। চারদিকের সমতল গ্রামাঞ্চল পরিষ্কার চোখে পড়ছে। যেন নিখাদ সবুজ জলরঙে আঁকা সব। টিলার মাঝ বরাবর কয়েকটা ঘোলা মানির ছোট হ্রদ। কিন্তু স্বচ্ছ কাঁচের মত নীল পানি কোথায় ? একজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো। বর্ষায় পানি ঘোলাটে হয়ে জায়। তবে শীতে এই পানি স্বচ্ছ নীল থাকে। কিছুটা আশা ভঙ্গ হল। নীল পানির হ্রদ দেখতে পেলাম না। বিচিত্র রঙ্গয়ের আকরিক এর টিলা। আকরিক কেটে নিয়ে যাচ্ছে বস্তা ভরে। আর শূন্য জায়গা গুলি পরিণত হচ্ছে এমন কৃত্রিম হ্রদে। লালচে চিনামাটির প্রাদুর্ভাবই বেশি। এই মাটিই পরে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হবে প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র। খানিকটা সময় নিয়ে টিলা গুলি ঘুড়ে দেখে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। এর মাঝে বিকেল গড়িয়ে গেছে। হাজং মাতা শহিদ রাশিমনির স্মৃতি স্তম্ভ পেছনে ফেলে ডানে বাক নিয়ে আমরা আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু করলাম।
আশিক কে আবার জিজ্ঞেস করলাম আমাকি ঢাকায় ফিরছি? কিন্তু তার জন্য আমাদের সময়টা একেবারেই উপযোগী নয়। আমরা সিধান্ত নিলাম কোন এক উপশহরে রাত কাটিয়ে কাল ফিরে যাব ঢাকায়। সোমেশ্বরীর পাশে শিবগঞ্জ বাজারে এসে চা খেয়ে (পান করে) সম্ভাব্য রাত কাটাবার উপযোগ শহর খোঁজ করছিলাম। আমার জীবনে প্রথম সুজির সিঙ্গারা (হয়তো শেষ বারের জন্যও) এই বাজারেই খেলাম। আমরা শিধান্ত নিলাম যতটা পথ এগিয়ে রাখা যায় আগামীকাল ততোটাই মঙ্গল। তাই ভাল হোটেল আর এ টি এম প্রাপ্তির সম্ভাব্যতা যাচাই করে নেত্র কোনায় রাত কাটাবার সিধান্ত নিলাম। দিনের আলো অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। আমি একটু হেঁটে নদীর পাশে এসে দাঁড়ালাম। পুরোটাই বালুচরের বিরাট নদী। পানি তেমন নেই। বালুর চর গুলির ফাঁক গলে ক্ষীণ ধারার মত বোয়ে চলছে পানির প্রবাহ। অনেক মানুষ এই সন্ধ্যে বেলাতেও এখানে নদীর বুকে কাজ করছে। আবছা আঁধারে বোঝা যাচ্ছে না তারা আসলে কি করছে। অনেক দূরে নদীর ওপাড়ে আলো দেখা যায়। সোমেশ্বরীর ওপাড়ে সুসং দুর্গাপুর। সারাদিন খেটে খাওয়া মানুষ গুলি বাজারের এখানে সেখানে চায়ের দোকানে জড় হয়েছে। খুব ঢিমে তালে গল্প গুজব করছে। এখানে বহমান জীবন বড় শান্ত মনে হয় আমার। এখানে সবাই সন্ধ্যার আগে বিকেলের আলো ফুরাবার আগেই দৈনন্দিন কাজ শেষ করতে পারে। আগামীদিন শুরুর কোন তাড়াও নেই হয়তো। সন্ধ্যেটা হয়তো সারাদিনের সুখ দুঃখের জাবড় কেটেই চলে যাবে এইসব মানুষের।
আমরা নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। পেছনে ফেলে যাচ্ছি আঁধার এর মায়া মাখা অচেনা জনপদ। আমাদের সোমেশ্বরী ওপাড়ে ৩৭০৪ নাম্বার লোকাল ডিভিশনাল হাইওয়েতে পৌঁছতে হবে। কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করলাম নদী পারি দেয়ার উপায় কি ? গাড় অন্ধকারের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বল্ল ” এইখান থেকে সোজা বাইক নিয়ে ওপাড়ে চলে জান” সামনে একটা নৌকা পাবেন ওইটা দিয়া পাড় হইতে পারবেন”। কিছু না বুঝে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। নদীর মধ্যে বাইল যাবে কিভাবে। হটাত দেখি নদীর ঠিক মাঝ বড়াবড় একটা বাইক ছুটে আসতেছে। অন্ধকারে বাইকের আলোতে যা দেখলাম টা বেশ চাঞ্চল্যকর। গোড়ালি পানিতে নদীর মাঝ দিয়ে বাইক ছুটছে। আশিক বেশ সাবধানে নদীর উঁচু পাড় থেকে বাইক নিয়ে নিছে নামল। আমি পিছে পিছে জুতা মুজা খুলে যাচ্ছি। নদীর বুক জুড়ে সবটাই পাথুরে বালি। ঝড় ঝড়ে বড় দানার বালি। পয়ায়ের সাথে লেগে থাকে না। ঝড়ে যায়। এটাই মূল্যবান সিলেট বালু নামে খ্যাত। শত শত নৌকা নদীর মাঝ বড়াবড় এই বালু উত্তোলন এ ব্যাস্ত এই রাতেও। তাদের কর্মযজ্ঞের শব্দও কানে আসে। এক রকম চোখের আন্দাজে নদীর মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি কোথাও গোড়ালি পানি আবার কোথাও হাঁটু পানি। একটু পরেই একটা কেয়া নৌকা পেলাম। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। টেনে টুনে বাইক উঠিয়ে ফেললাম। সোমেশ্বরির ঠিক মাঝ বরাবর অল্প একটু জায়গা যেখানে কোমর বা মাথা গভীরতা, অই জায়গা টুকু আমরা নৌকায় পাড় হয়ে এপাড়ে উঠে এলাম। লেখার শুরুতে ফিরে এসেছি আবার। এই পথ ধরে ঘণ্টা খানেক চালিয়েই আমরা সেই নাম না জানা কাল্ভারট এর উপড়ে বসে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি দেখছিলাম। এই লেখার শুরুতে এই গল্পের শুরুটা ঠিক এখানেই করেছিলাম। আরো ঘণ্টা দুয়েক চালিয়ে আমরা নেত্রকোনা শহরে পৌঁছেছিলাম। যথারীতি হোটেল খোঁজা ও সব শেষে কোন রকম রাত কাটিয়ে দেয়ার মত এক হোটেল খুঁজে বের করা। একটা ঘুমানসই হোটেল ঠিক করে প্রায় রাত ১১ টায় প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে খাবারের খোঁজে বের হলাম। একেবারে ক্ষুদ্র এই শহরেও একটা রাস্তা একেবারে শগরম হয়ে জেগে আছে মধ্যরাতে। রিকশাওয়ালা টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে আমাদের এই রাস্তায় একটা হোটেলের সামনে নামিয়ে দিল। বীভৎস নোংরা পরিবেশ আর ভয়াবহ নিম্নমানের খাবার দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিলাম। কালো রঙ এর হাঁসের মাংস ভুনার বাটিতে যদি একটা টিকটিকি ভুনা আসতো, ম্যাড় ম্যাড়ে আলোতে সেটা বোঝার উপায় ও থাকত না।
সকাল হয়েছে অনেক আগেই। একটু দেড়িতেই আমরা ঘুম থেকে উঠেছি। আজ রাজধানীতে ফিরে যাব। কোন তাড়া নেই। আলসেমিতেই ধীরে সুস্থে শহর ছাড়লাম। পথে পড়লো ময়মনশিং শহর। অনেক বার এই শহরে এসেছি আগে। আশিক কে ব্রহ্মপুত্র দেখাতে ইচ্ছে হোল। তার থেকেও বেশি ইচ্ছে ছিল ব্রহ্মপুত্রে সাঁতার। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে নেমে গেলাম ব্রহ্মপুত্রে। নদীর পানির শীতল স্রোতে সাঁতরে বেড়ালাম। এই নদী আমার ভালোলাগার কারন হয়ে গেছে যেকোনো কারনেই। হটাত মনে পড়লো এখানে আশিক সহ আগেও এসেছিলাম! এর পরে প্রায় এক টানা বাইক চালিয়ে আশিক ঢাকায় আমাকে উত্তরায় নামিয়ে রামপুরা ফিরে গেলো। দীর্ঘ পথের ধকল আস্তে আস্তে এখন আমাকে গ্রাস করবে। কিছু যায় আসে না যদিও। এটা একটাই জীবন আমার! কখনো শুধু নিজের জন্যেও বটে।
সময়ঃ ৩০ এপ্রিল – ৩রা মে ২০১৫ । শেরপুর, দুরগাপুর, নেত্রকোনা, ময়মনশিং
ফুট নোট ঃ এই গল্পে ঢাকা থেকে শেরপুর পথের বর্ণনা নেই। শেরপুর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে কাদা মাটিতে একাকার হয়ে বাইক টেনে নিয়ে যাওয়ার গল্পটাও নেই। হয়তো অন্য কোন গল্পে আবার ফিরে আসবে।