ঈদ

এটা এমন একটা সময় ছিল যখন শৈশব কৈশোরের আনন্দ গুলি বুঝতাম আর চার পাশের মানুষ গুলিকে চেনার বা বোঝার চেষ্টা করতাম কে কতটা সুখী, হাসিখুশি বা আনন্দিত এই বিশেষ বিশেষণ গুলির মধ্যে দিয়ে। তখন ভয়, সংকট, হতাশা গুলি একটা অচেনা বাতাসের মত অনাকাঙ্ক্ষিতের মত ধরা দিত। বেঁচে থাকতাম কিছু চিরচেনা মানুষের কোলাহলে।

তখন বরিশালেই থাকি ঈদ গুলিতে দাদা বাড়িতে আমাদের গ্রামে ফিরে যেতাম অল্প কয়েক দিনের ছুটিতে। সাধারণত মাই নিয়ে জেত কারন আব্বা ঢাকা থেকে সোজা বাড়ি চলে যেত। সেবার এমনি এক কোরবানির ঈদে আমরা দাদা বাড়িতে। বাড়িতে একটা বিশাল উৎসবের পরিবেশ। আমার দাদি তখন ততোটা অসুস্থ হয়ে পড়েনি। শান্ত আর বেশ সরল স্বভাবের ছিল দাদি। স্মৃতির কোন এক অদ্ভুত আচরণে ছেলেবেলায় দাদির যত স্মৃতি ছিল সব মুছে গেছে। অল্প কিছু স্মৃতি ছাড়া ছাড়া ভাবে উঁকি দেয়। আমি স্মৃতির এই দ্ভুত আচরণে বেশ হতাশা পড়ি মাঝে মাঝে। এমনটাও হতে পারে যে স্মৃতি ইচ্ছে করেই দাদির অংশটুকু মুছে দিয়েছে। তার সমুচিত কারন ও রয়েছে। আমার দাদি মারা গেছেন বছরের পর  বছর অমানুষিক অসুখে ভুগে। তার সেই জ্বরা গ্রস্থ সময় টাকে আমি কখনোই ভুলতে পারবো না। আমি দাদির সেই অসহায়ত্বকে যখনই ভাবি তখনই অসহায় বোধ করি। তার পৃথিবীটা একটা ছোট খাটে আটকা পড়ে গিয়েছিল।আসলে দাদির গল্প না আসলে আমি আমি শৈশবের অন্য আরেকটা ছট গল্প বলবো।

দীর্ঘাকায় ঋজু যে মানুষটা আমার সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতো সে আমার দাদা। আমার উচ্ছল কৌতূহলের সব কিছু তাকে নিয়েই। দাদা রহস্য পছন্দ করতো। সব কিছুতেই তার কিছুটা রহস্য থাকতো আর আমার থাকতো হাজারো প্রশ্ন। হয়তো দাদা আমাকে একটু উৎসাহী করতেই এমনটা করতো ইচ্ছে করেই। দাদার গোয়াল ভরা গরু থাকলেও দাদাকে আমি কখনো গোয়ালের গরু কোরবানি দিতে দেখি নাই। আমরা প্রতিবছর গরু কিনতাম। তবে সেটা অনেক সময় হাটে যেয়ে কেনা হোত না। দাদা খুব সাবধানী আর বিচক্ষণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন  মানুষ ছিলেন। তিনি সব থেকে ভাল গরুটা গ্রামের কারো কাছ থেকে কোরবানির আগেই কিনে রেখে দিতেন। দেখা জেত কোরবানির হাটে এই গরুটাই হয়তো অনেক দামে বিক্রি হোতো। একটা চলতি কথা আমি আমরা সবসময় শুনে এসেছি। আমাকেও অনেকে বলতো। কাঞ্চন আলি শিকদারকে কখনো কেউ ঠকাইতে পারে নাই।

যাইহোক এইসব গরু কেনা নিয়ে দাদা আর আমার মাঝে প্রতি ঈদেই নানান দ্বন্দ্ব যুদ্ধ চলতো। গরু কেন আগেই সে কিনে ফেলে! কেন আমাকে হাটে নিয়ে যায় না এই গুলিই ছিল দ্বন্দ্বের কারন। দাদা নিরুপায়ের মত আমার ছোট্ট শরীরটাকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বুঝাত গরুটা কত ভালোই না সে কিনেছে, গরুটা কত চমৎকার দেখতে, এইসব! আমার অভিমানটা কমত বলে মনে পড়ে না।

সেবার মা আমাকে আগেই বলেছিল দাদা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বাড়ি গেলে আমাকে নিয়ে হাঁটে যাবে গরু কিনতে। আমি অনেক অনন্দে বাড়ি জাওয়ার দিন গুনতে থাকি। তখন ছিল বর্ষার প্রথম দিক। প্রতিবছর ক্যান জানি ঈদের দিন সকালে বৃষ্টি হবেই। বৃষ্টি হলেই সব আনন্দ মাটি। দাদা যেন সব কিছুই জানতেন। আমার সকল প্রশ্নের উত্তর তার কাছে থাকতো। দাদা আগেই আমাকে বলে শান্ত রাখার চেষ্টা করতো বৃষ্টি হবে না।

সেবার গরু কেনাটার গল্পটা শেষমেশ আমার কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক বিশাল যুদ্ধ জয়ের অভিযান। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়া হোল দাদার সাথে গরু কিনতে জাওয়ার জন্য। গ্রামের হাঁট গুলিতে সাধারণত সকালেই যায়। যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভাল নেই এই দিকে। হাঁটও সীমিত। আমি এর আগে কখনো আমাদের গ্রামের গরুর হাঁটে যাই নাই। খুব ভোরে কাঁচিখোঁচা পিঠা রসের গুড় আর নারিকেল দিয়ে খাওয়া খুব পরিচিত বিষয় ছিল আমাদের বাড়িতে। আমার খুব প্রিয় একটা খাবার। আমরা খেয়ে যাত্রা শুরু করি। এতো দূর হেঁটে জেতে পারবো কিনা সেই সন্দেহ থেকেই আমার মেঝ চাচা আমাকে বার বার আমাকে রাস্তার দূরত্ব আর নানা প্রতিকূলতা জানিয়ে আমাকে না জাওয়ার জন্য বলে যাচ্ছিল। আমি নাছোড় বান্দার মত পেছন পেছন রওনা দিলাম।

উত্তরের শ্রীমন্ত নদীর ওপর তখন ব্রিজ হয়নি। নদী পার হতে হয় নৌকায়। উত্তরে এই নদীটাই আমাদের গ্রামের শেষ সীমানা। পথ চলা যেন শেষ হয় না। মাটির রাস্তা আর রাস্তার দুই ধারে বড় গাছের সারি। কিন্তু আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। আমার আর পা টানে না। দাদা কে যখনই জিজ্ঞেস করি আর কতটুকু রাস্তা বাকি তখনই সে বলে আর বেশি নাই এই তো চলে এসেছি। ওই যে দূরে যে বাড়িটা দেখতেছ এর পরেই। এভাবে কত বাড়ি চলে গেল পথ আর শেষ হয় না। শেষমেশ আমি চাচাকে নিয়ে মাঝ পথেই বাড়ি ফেরার বায়না ধরি। মনে হয় আমি আসলেই গরু কিনতে জাওয়ার ব্যাপারটার গভীরতা বুঝিনি, হাল্কা ভাবে নিয়ে ছিলাম। আমাকে অনেক বুঝি শুনিয়ে বাকিপথ অনেক কষ্টে নিয়ে জাওয়া হোল। তখন দুপুরের তপ্ত সূর্য মাথার উপর ভীষণ খ্যাপা। অনেক কাঙ্ক্ষিত গরুর হাঁট এর দেখা মিলল। রাস্তার বাঁয়ে বিশাল খোলা ধানের মাঠ। ধান কেটে নিয়েছে আগেই। সেখানেই বসেছে হাঁট। আয়তনে শহুরে হাঁট গুলির মত নয় বটে। তবে এখানে হাটের পরিবেশটা অনেক শান্ত আর আয়েশি। গরু গুলি বেঁধে রেখে ছাতি বা ছাউনির নিছে খড়ের গাদার উপর ঝিমুচ্ছে ব্যাপারীরা। হাঁটের মধ্যে গাদা গাদি নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে হাঁট। হাট জেন একটা ছোট খাট মেলার মাঠ। অনেক দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এসেছে গরু কিনতে। অবাক করা ব্যাপার এদের অধিকাংশই একে অপরকে চেনে। দেখা হলে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বা বুকে টেনে নিচ্ছে কেউ কেউ। মনে হয় অনেক পুরনো পরিচয়। গ্রামের পরিবেশটা এমনি। একটা নাগর দোলা বসাচ্ছিল হাঁটের পাশেই। আর সেটা ঘিরে অল্প বয়সী ছেমে মেয়েদের একটা জটলা। তারা বেশ উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন নাগর দোলার চরকি পাক কাটবে। মনেক্কার ফেরিওয়ালা এরিমাঝে আমার নজর কেড়েছে।

আনাড়ি পায়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়াতে আমার আর হাঁটের প্রতি আগ্রহ তেমন অবশিষ্ট নেই কিছু বিশেষ। আমরা কয়েকটা গরু দেখলাম। আমার স্বাভাবিক ভাবেই বড় গরুগুলির দিকে আগ্রহ বেশি। চাচা আর আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি। দাদা হটাত উধাও! আমি এদিক এসদিক খুঁজে তাকে পাচ্ছি না। চাচা আমাকে আশ্বস্ত করলো যে সে হয়তো কোন ব্যাপারীর সাথে দাম দর করছে। একটা গরু কত নিখুঁত ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা যায় তা চাচাকে না দেখলে আমি জানতাম না। আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছি আমরা একটা গরু কিনে ফেলছিনা কেন ? অনেক গুলি ভাল গরু তো আমরা দেখলাম। তখনও বুঝতে পারি নি সামনে আরো কি বিচিত্র অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমার ক্ষুধা পেলো। হাঁটের একেবারে উলটো দিকেই আমার ফুফুর শ্বশুর বাড়ি। দাদা আমাকে নিয়ে সেখানে গেলেন দুপুরের খাবার আর বিশ্রামের জন্য। আমরা যখন হাঁটে ফিরে এলাম তখন আমার ভেতর কিছুটা প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। এবার বুঝি আমরা একটা গরু ধ্রুত কিনে বাড়ির পথ ধরবো। আমি অদ্ভুত ভাবে লক্ষ্য করলাম আমরা হাঁটের সব গরু একে দেখে ফেলেছি এবং প্রায় সব ব্যাপারীর সাথে কোন না কোন গরুর দাম দর করে ফেলেছি। অথচ কোন গরুই আমরা কিনছি না। দাদা প্রাই দলছুট হয়ে কোন এক ব্যাপারীর সাথে খুব একান্তে কি জানি আলোচনা করছে। এটাই হয়তো দর দাম করার নিয়ম! শেষমেশ আমি নাছোড়বান্দার মত একটা গরুর দেখিয়ে বল্লাম এটাই কিনতে হবে। দাদা একটু বিরক্ত হয়ে আমাকে আরেকটু ধৈর্য ধারণ করতে উপদেশ দিলেন।

 

এখন কেন জানি হাঁটের সব গুলি গরুরই আমার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছে। খালি দাদা যে গরুটা পছন্দ করে দাম দর করছে ওই গরুটাই অপরিচিত ঠেকছে। একটা পাঁজরের হাড় জাগা লম্বা গড়নের ধূসর সাদা গরু দাদার খুব পছন্দ হয়েছে। যে গুরুটার দুইটা শিং এর মাঝে একটার মাথা ভাঙ্গা কোন কারনে। এমন একটা গরু আমার কোনভাবেই পছন্দ হচ্ছে না। অনেক বলে কোয়েও যখন বুঝতে পারলাম কোন এক অদ্ভুত কারনে আমরা হয়তো এই গরুটাই কিনতে যাচ্ছি তখন আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হোল। দাদাকে অভিমানের কথা শুনালাম। একটা গরু কিভাবে চিনতে হয় সে ব্যাপারে আমাকে প্রায় তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে অনেক কিছু উপড়ে দিলেন। তাতে আমার বয়েই গেছে। আমার পছন্দের বড় গরুটা কেন কিনবে না দাদা এইটা ভাবতে ভাবতে আমি বাজারে ঘুরতেছি। হাল ছেড়ে দিয়ে ওইটাই কিনে ফেলে বাড়ি ফিরতে বলি বলি কারন, প্রায় ১৪-১৫ কিলোমিটার যে রাস্তা হেঁটে এসেছি আবার গরু নিয়ে ওই একি পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। দাদা পড়ন্ত বিকেলে এক অদ্ভুত দক্ষতায় শেষমেশ সেই গরুটা অবিশ্বাস্য দরদামের শেষ পর্যায়ে এক অদ্ভুত দামে কিনে নেয়। আমার যতদূর মনে পরে দাদা ১৯৫০০ টাকা দিয়ে গরুটা কিনে। এই দামে কিভাবে গরুটা সে ব্যাপারীর কাছ থেকে কিনলো সেটা আমি অনেক ভেবেছি পরে কিন্তু কোন রহস্যের কুল কিনারা পাইনি।

dadaবিকেল গড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে গ্রামের পথে। হিমেল বাতাসে মাথার উপর অদ্ভুত বিশাল সুন্দর চাঁদ। পদ্মা নদীর মাঝে দেখা চাঁদ আর এই চাঁদ এর মাঝে কি অদ্ভুল মিল। ক্লান্তি আর মন খারাপ নিয়ে গরুর পিছে পিছে হেঁটে প্রায় রাত ১০টার দিকে আন্দুয়ায় ফিরি আমরা। বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের গরু নিয়ে ফেরার। কাঁঠালতলির সেই পথে কত বার গেছি হিসেব নেই। পথের দুই ধারে বিশাল গাছ গুলি এখন হয়তো গ্রীষ্ম-বর্ষা পাড়ি দেয়। এখন কত গল্প জন্ম নেয় প্রতিদিন। আমার আর আমার দাদার গল্পটা আর হবে না এখানটায়। চোখগুলি বন্ধ করলেই দেখতে পাই দাদা আমার হাত ধরে আছে। পাশে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। রাস্তার দুই ধারে আকাশ ছোঁয়া গাছের সারি। বিকেলের আলোছায়ার আসা জাওয়া। দাদা মুখে একটা স্মিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার হাত ধরে। কেন জানি মনে হয় জীবনের সব প্রাপ্তি তাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল।

ভাল থেক কিংবদন্তি। ভাল থেক। আবার দেখা হবে। দেখা হবেই।

 

__________________________
ইয়ারুজ্জামান
সেপ্টেম্বর ২০১৬, টরন্টো।

 

 

Share your thoughts