পেত্রভানিয়ার দিনগুলি ঃ দ্বিতীয় খন্ড (চিঠি – ৭)
প্রিয় জয়ন্তী,
পথে পথে অচেনা শহর আর অচেনা মানুষের মুখ। কখনো পেছনে ফেলে যাচ্ছি সুবিশাল ভাস্কর্য অথবা গগন ছোঁয়া টাওয়ার। আবার হঁঠাত গাড়ি বাঁক নিয়ে যাচ্ছে ম্যাপল বনের ধার ঘেঁষে। যখন ফিনিক্স রিজার্ভের সেন্ট্রাল ইকনমিক্স সেন্টারের গেটে আমাকে নামিয়ে দেয়া হলো তখন আমি কিছুটা ক্লান্ত আর জার্নির ধকলে হাপ ধরে আছি। ট্যাক্সির ড্রাইভার আমাকে বিদায় জানিয়ে বলল “আশা করি ফুল গুলি এখনো সতেজ আছে, পেত্রভানিয়াতে স্বাগতম”। একরকম উষ্ণ অভ্যর্থনার বিপরীতে আমি এক রকম ফাঁকা হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলাম গাড়িটা কেটে না পড়া পর্যন্ত।
গেট দিয়ে ঢুকে এক হাতে ট্রাভেল লাগেজ আরেক হাতে ফুল নিয়ে আমি উৎসুক ছাত্র ছাত্রীদের পাশ কাটিয়ে তথ্য অনুসন্ধান বিভাগটি খুঁজে চলেছি। সামন্য গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে অনুসন্ধান দপ্তরে এসে উপস্থিত হলাম। ডেস্কে একজন বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক ও তার সহযোগী তরুন একটি ছেলে দায়িত্ব পালন করছে। বয়স্ক ভদ্রলোকটিকে না ঘাটিয়ে বরং তরুনটিকে ঘটানোই আমার কাছে যুক্তি যুক্ত মনে হলো। বয়স্ক ভদ্রলোক হাতের বইটি থেকে মুখ তুলে একবার আমাকে দেখে নিলেন। ঠান্ডায় হাত দুটো আমার জমে গেছে প্রায়। ওভার কোটের ভেতরে হাত দুটি ঢুকিয়ে আমি আমার পরিচয় দিলাম। আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দিল। যথা রীতি আবারো হাত বের করে খানিকটা হাত মিলিয়ে নিলাম ও সাথে সাথেই আমি আমার এখানে সার উদ্দেশ্যটি বলে দিলাম। ছেলেটি প্রয়োজনীয় যে সকল তথ্য আমার কাছে যা জানতে চাইল তার প্রায় কিছুই আমি দিতে পারিনি, শুধু মাত্র তোমার নামটি ছাড়া। বিশাল স্প্রেড মনিটরে সে দ্রুত তোমার নামটি দিয়ে খোঁজা শুরু করলো। সে আমাকে একটি তথ্যই জানালো “জয়ন্তী! অপারেশনাল ইকোনমিক্স ও প্রজেক্ট ডেভলপমেন্ট বিভাগের একজন রিসার্চার।” আমি তাকে আশস্ত করে বললাম “জনাব আপনার তথ্যটি সঠিক এবং আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই”। আগের থেকেও দ্রুত হাত চালিয়ে মনিটরে কিছু নির্দেশ দিয়ে মাইক্রোফোনে যেন কার সাথে কথা বলছে ছেলেটি। এর পরেই আমাকে একটি কাগজে কিছু তথ্য প্রিন্ট করে দিয়ে আমাকে কি করতে হবে সেটা বলে দিল। এখন আমার গন্তব্য ইকোনমিক্স বিভাগের ৩য় তলায়, কক্ষ নম্বর ৩১৭। আমাকে অনুরোধ করা হলো আমার প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য দেয়ার জন্য। আমি আমার হাতের ফুল গুলি ছেলেটির দিকে তুলে ধরে বললাম “আমি কিছুটা চমকে দিতে চাই! দয়া করে আমাকে সহযোগিতা করুন”। ছেলেটি বেশ আন্তরিক হাসি হেসে বলল “কেন্দ্রীয় তথ্য ভান্ডারে আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখা আমার কর্তব্য তবে আশা করছি আপনি তাকে চমকে দিতে পারবেন। আপনার দিনটি শুভো হোক”। এর পরে সে আমাকে কোন দিকে যেতে হবে তা হাতের ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিল। হাতের কাগজের নির্দেশনা মিলিয়ে আগাচ্ছি। বেশ কিছু ভবন ও একটা লম্বা মাঠ পেরিয়ে ইকোনমিক্স অনুষদের দোতলায় ৩১৭ নম্বর রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। একজন কে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। “অনুগ্রহ করুন” বলার সাথে সাথেই তিনি থমকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ভরা চোখে তাকালেন। হাতের কাগজটি তার দিকে এগিয়ে দিয়েই সাক্ষাৎ লাভের কথা জানালাম। তিনি সম্ভাষনের হাসিটি মুখে রেখে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে চলে গেলেন।
আমার বুকের খাঁচার নিচে ধমনী গুলি কিছুটা দ্রুত কাজ করে যাচ্ছে যেন। কিছুটা উদ্বিগ্নতা, চাপা উচ্ছাস, আর কি যেন একটা শংকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওই কয়েকটা মুহূর্ত। আমাদের দেখা হয়েছে মাত্র একবার তাও খুব অল্প কয়েকদিনের জন্য। এর পরে কতগুলি সময়ের চাদরে আমরা আমাদের আবেগ অনুভুতির নকশা এঁকে গেছি আমাদের মত করে। কবে যে সেখানে জটিল নকশায় আমাদের দুজনার চাওয়া পাওয়া আর ভালবাসা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে! সেই শীর্ষ অনুভূতিটির আজ এমন বাধাহীন দুর্নিবার প্রকাশ যা ভুলিয়ে দিয়েছে আমার সব পারিপার্শিকতা। ভদ্রলোকটি একাই বেরিয়ে আসলেন ও আমার অপেক্ষা বাড়িয়ে দিয়ে ২২৭ রুমে যেতে বললেন। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে আমার লাগেজটা তুলে নিয়ে লিফটের দিকে আগাতেই খুব চেনা আর খুব প্রত্যাশিত একটি মুখ আমার দৃষ্টিজুড়ে ভেসে উঠলো। আমাদের দুজনার জন্যই ব্যাপারটা ছিল অপ্রত্যাশিত। তুমি ব্যস্ত পা ফেলে মাথা নিচু করে রুমে ফিরে আসছিলে নিচ থেকে কতগুলি কাগজের তোড়া নিয়ে। চোখা চোখি হয়ে যেতেই একরাশ বিস্ময় নিয়ে তোমার চোখ গুলি অজস্র প্রশ্ন নিয়ে চেয়ে ছিলে। তোমার বিস্ফারিত চোখ গুলি যেন সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে পেতে চাইছে। করিডরে কেউ হয়ত শব্দ তুলে হেঁটে গেল খুব দ্রুত। নিচে কেউ হয়ত কাউকে চিৎকার করে একবার ডাকলো। এরপরে সব কিছু শুনশান আবার। অনেক প্রতিক্ষার আর অনেক অজানা সময় পেছনে ফেলে আজ অজানা দুটি গল্প মুখোমুখি। ঘটনার দ্রুততায় আমরা দুজনেই কয়েকমুহুর্তের জন্য নির্বাক হয়ে যাই। আমি সন্তপর্নে লাগেজটি নিচে নামিয়ে রাখি। ততক্ষনে তোমার দুটি প্রসারিত বহু আমাকে ঝড়ের বেগে জড়িয়ে নিয়েছে। লেসে বাধা এক রাশ ইষৎ বাদামী চুল আমার মুখ ঢেকে দেয়।
চোখ মুছে যে প্রথম যে কথাটি বলেছিলে “এভাবে চলে এলে? আমাকে কিছুই জানাও নি !” আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে একছুটে রুমের ভেতরে চলে গেলে আর পরক্ষনেই ফিরে এলে একটা ওভার কোট আর ব্যাক প্যাক নিয়ে। “আমি আজকে আর কাজ করছি না, চল বাড়িতে চলে যাই” বলেই আমার লাগেজটা একহাতে টেনে নিয়ে আরেক হাতে আমাকে শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করলে। যখন আমরা পার্কিং এসে তোমার ব্যাগ ঘেঁটে বের করলে একটা মাফলার যার রং কিছুটা উজ্জল কমলার মত ফুটকি প্রিন্ট। আমাকে একরকম জোর করে গলায় পরিয়ে দিয়ে মাফলার না পরার নানা অপকারিতার উপর একটা ছোট্ট বয়ান দিয়ে দিলো। আমি সেই অদ্ভুত মাফলার পরে গাড়িতে উঠে পরলাম।
পুরো পথ জুড়ে তোমার অজস্র প্রশ্নের উত্তর দেয়া আর আমার মাঝে মাঝে রাস্তাঘাট, বিল্ডিং আর মানুষজন সম্পর্কে আমার দু একটি প্রশ্ন। গাড়ির হিটারটা বেশ আরাম দিচ্ছে। এর মাঝেই ঝির ঝির বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললে। আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিলাম নিজেকে। বলেছিলে “বার বার ভেবেছ আমি কবে আসবে? আদৌ আসতে পারবো কিনা? একটিবার জানাওনি কেন?” আমার সব ভালোলাগার অনুভুতি নিয়ে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছি। তোমার ভেজা চোখ গুলি হটাত কি যেন পাওয়ার আনন্দে বার বার উজ্জল হয়ে উঠছে। এখানে যেই ডর্মে তুমি থাক সেখানে আমরা একসাথে থাকতে পারবো। ওরা ১ জন অতিথি থাকার অনুমতি দেয় যদিও তা একটানা ৩ দিনের জন্য। আপাতত আমি তোমার সাথে এখানেই থাকছি এই কয়দিন। পরে আমরা একটা হোটেলে উঠে যাব। যেতে যেতে এটাই আমরা প্রাথমিক ভাবে পরিকল্পনা করে ফেলি।
বিকেল প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুটা ক্লান্তিতে কখন যে গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছি বুঝিনি। পেত্রভানিয়াতে আমাদের দুজনার একসাথে পথ চলার শুরুটা হয়েছিল ঠিক এভাবেই। এর পরে অনেক বিকেল পেরিয়ে গেছে। আমাদের একসাথে পথ চলার শুরুর এই মুহূর্তটির মত আর কোনো মুহূর্ত ফিরে আসেনি। আমরা অনেকবার একসাথে এখানে ফিরে এসেছি আমাদের শুরুর দিকের জীবনের এই গল্প গুলি খুঁজে পেতে। তোমাকে সবিশেষ ধন্যবাদ দেয়াই যায় সব কিছুর জন্য।
*সংযুক্তি : পেত্রভানিয়ার দিনগুলি ঃ প্রথম খন্ড