পেত্রভানিয়ার দিনগুলি ঃ প্রথম খন্ড (চিঠি – ৬)

প্রিয় জয়ন্তী,

পেত্রভানিয়ার দিন গুলির কথা কি মনে আছে তোমার? উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষা সুবিন‍্যস্ত বড় সে শহর। তোমার ছোটবেলার শহর। যেখানে কেটেছে তোমার শৈশব আর কৈশোরের অনেকটা সময়। আমাদের প্রথম পরিচয়ের পরে সেই যে ফিরে গেলে তুমি পেত্রভানিয়েতে। তোমার পড়াশোনা শেষ করেই ট্রান্স ইউনিকোর সাউথ পার্ক মেইন সাপ্লাই এ ফিরে আসার কথা। তোমাকে যখন সাউথ পার্ক নভো লাউঞ্জে বিদায় জানাতে এসেছিলাম তখন আমার হাত দুটি জোরে চেপেধরে অনেক করে বলেছিলে, আমি যেন খুব তারাতারি পেত্রভানিয়াতে যাই তোমার কাছে। তুমি অপেক্ষা করে থাকবে। তার পরে বিদায়ের শেষ মুহূর্তেও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেটে আবার বলেছিলে আমি যেন নিজের যত্ন নেই, আর যেন খুব তাড়াতাড়ি পেত্রভানিয়াতে যাই। সন্ধ‍্যার আকাশে তোমাকে নিয়ে উড়ে যাওয়া প্লেনটা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার ভাবনারা সব তখন তোমার স্মৃতি নিয়ে পেত্রভানিয়া অভিমুখে যাত্রার জন উদগ্রীব। কতক্ষন যে নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই।

সাউথ পার্ক থেকে পেত্রভানিয়া অনেক দূরের পথ …. প্রায় পৃথিবীর ওপর প্রান্তে বলতে গেলে। আমি ফেরার পথেই সিধান্ত নিয়ে ফেলি আমি আসন্ন শীতেই পেত্রভানিয়া চলে যাব। আমাকে কিছুটা ঘুছিয়ে নিতে হবে সব কিছু। আর দরকার পড়বে বেশ কিছু দিনের জন্য ছুটি। আমাকে ভ্যাকেশন লোন এর ব্যবস্থাও করতে হবে। এই মুহুর্তে হাত খালি। নতুন চাকরিটা আমাকে যথেষ্টই যন্ত্রণা দিবে। তবুও আমি আমার সিধান্ত থেকে সরে আসতে পারছি না।

পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের এক শহর যেখানে ৭-৮ মাস জুড়েই বরফে ঢাকা থাকে। মাঝের শীতকে বলা হয় এখানে ডেড লক উইন্টার। তাপমাত্রা প্রায় -৩৫/৪০ এ নেমে যায় অনায়াসেই। আমার ছুটি পেতে পেতে কিছুটা দেরী হয়ে গেল। যদিও সেটা আমার জন্য কিছুটা ভালই হলো। ডেড লক উইন্টার পেতে হয়নি। আমি যখন পেত্রভানিয়ার পৌঁছি তখন শীতের প্রকোপ কমে এসেছে অনেকটাই কিছু দিনের মাঝেই বসন্ত শুরু হবে। তাপমাত্রা -৩/৪ এর থাকে দিনের উষ্ণ সময়ে সেটা ৪/৬ এ ওঠা নামা করে। সব প্রস্তুতি নিতে গিয়েও সব ভজঘট পাকিয়ে ফেলি শেষটায়। ডেমিয়েন কে এখানের কিছু কাজ বুঝিয়ে দিতে গিয়েই বিপত্তিতে পড়া গেল। বেচারা একেবারে শেষ মুহুর্তে জ্বরে পড়ে গেল। শেষতক সিধান্ত হলো ডেমিয়েন ফরেস্ট লনেই থাকছে কিছুদিন। জারা ফ্রীয়দিকে কে ডেমিয়েন এর কথা জানালাম। সে বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে পাশের শহর থেকে চলে এলো সন্ধ‍্যায়। ডেমিয়েনের এই প্রেমিকাটি বেশ পরিপক্ক বুদ্ধির মেয়ে। সে এসে পরিস্থিতি দেখেই আমাকে আশস্ত করে বলল সে ডেমিয়েন সেরে না ওঠা পর্যন্ত ফরেস্ট লনেই ডেমিয়েনের সাথে থাকছে। আসলে জারার জন্যই সে যাত্রা সব কিছু শেষমেষ একটা গুছানো রূপ রূপ দেয়া গেল। আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে সব কিছু ম্যানেজ করে জারা আমাকে সিঅফ করতে নভো লাউঞ্জে চলে এলো প্রায় ৪০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে। জোর করে কতগুলি চকলেট আর ফুলের তোড়া কিনে দিল। আমার ব্যাগেজ কার্গোতে চলে গেছে ইতিমধ্যে। সে আমাকে কিছুটা হুকুমের সুরে বলল “তুমি তোমার প্রেমিকার কাছে যাচ্ছ খালি হাতে! এটা খুবই অশোভন ও শাস্তি যোগ্য অপরাধের মধ্যে পড়ে। এই ফুল চকলেট হাতে নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হবে। সে খুশি হয়ে তোমাকে জড়িয়ে চুমু টুমু দিলেও দিতে পারে!” আমাকে ২ বার ট্রানজিট চেইঞ্জ করতে হবে আর পুরোটা পথ এই উপহার বয়ে বেড়াতে হবে এই কথা ভেবেই বেশ খানিকটা প্রেম কমে গেল। আমার সাথে ডিপার্চার এক্সিট পর্যন্ত হেঁটে এসে আমাকে বিদায় জানিয়ে জারা চলে গেল।

জয়ন্তী, সবসময়েই তোমার সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। কিন্তু তোমাকে বলা হয়নি কখনো যে আমি এভাবে পেত্রভানিয়া গিয়ে হাজির হব। আমি সারাক্ষণ ভাবতাম তুমি আমাকে হটাৎ ওখানে দেখে কতটা অবাক আর উচ্ছাসিত হবে। প্লেনে আমার পাশের ভদ্রলোক আমাকে জিগ্গেস করেছিল আমি কেন ফুল গুলি হাতে নিয়ে বসে আছি এই দীর্ঘ যাত্রা পথে। আমি কিছুটা লজ্জিত হয়ে তাকে উত্তর দিয়েছিলাম লাগেজ কেবিনেটে দিলে ফুল গুলি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রতিউত্তরে সে বলেছিল বিশেষ কারো জন্য বুঝি ! আমি শুধু হ্যা সুচক মাথা নেড়েছিলাম।

এবার শেষ ট্রানজিট থেকে সব থেকে লম্বা সময় জুড়ে উড়তে থাকবে বোইং এর ৭৭৭ বিমানটি। আমার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন প্লেনের জানালার বাইরে শুধুই শ্বেতশুভ্র প্রান্তর। সবকিছু বরফে ঢাকা। একটানা জানালার বাইরের দৃশ্যে চোখ রাখলে ২-৪ মিনিটের মাঝেই তা একঘেয়ে হয়ে যায়। আমি মনিটরে চোখ রাখি। এয়ার ক্রাফট এর ফ্রন্ট, রেয়ার ও উইং ক্যামেরার ভিউ গুলি মনিটরে দেখাচ্ছে। চট করে কেউ তাকালে বুঝবেনা যে এটা বাইরের দৃশ্য উপরন্তু ধারণা হবে এটা কোনো সাদা মনিটর। মনিটরের একটা নোটিফিকেশন বেশ কিছুটা হাসির যোগান দিল। বাইরের তাপমাত্রা -৫ ডিগ্রী। তবুও তারা এটাকে বলছে “আবহাওয়া চমৎকার!”

পেত্রভানিয়ার ছোট্ট এয়ারপোর্টটায় যখন নামি তখন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল। বার বার আমি বেখেয়ালী হয়ে যাচ্ছিলাম। বার বার ভাবছিলাম জয়ন্তীর সাথে আর কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা হবে। যদিও তখনও তুমি জানো না যে আমি পেত্রভানিয়াতে। তোমাকে চমকে দেব বলে কিছুই জানাইনি আমি। লোকাল ইমিগ্রেশন আমাকে জিগ্গেস করলো এখানে আমি কোথায় থাকছি। যদিও খুবই আনকোড়া ধাঁচের প্রশ্ন। আমি হটাৎ আবিষ্কার করলাম আমি কোনো হোটেল বুক করে আসিনি। আমি হাতের ফুল গুলি তুলে ধরে বললাম “আমার প্রেমিকার জন্য”। এখানে আমি তার সাথে ছুটি কাটাতে এসেছি। অফিসার খুব রোবটিক হাসি হেসে আমাকে পেত্রভানিয়াতে স্বাগত জানালো।

চলতি পথের বাগান
চলতি পথের বাগান

পেত্রভানিয়াতে এখন মাত্র দুপুর। আগেই জানতাম এখানের তাপমাত্রা সম্পর্কে। বাইরে বরফ পড়ছেনা কিন্তু সবটাই বরফে ঢাকা। এরাইভাল এক্সিট এর পাশে ভেসে উঠছে লোকাল তাপমাত্রা -৫ ডিগ্রী। আমি সোয়েটার আর ওভারকোট পরে নিলাম। হটাৎ আমি খেয়াল করলাম আমার জুতো গুলি এই তাপমাত্রার জন্য উপযুক্ত নয়। মোবাইল বের করে তোমার বাসার ঠিকানাটা আরেকবার দেখে নিলাম। ইচ্ছে করলেই আমি তোমাকে একটি কল করে এখানে নিয়ে আসতে পারি। আমি আসলে তোমার অদ্ভুত অনন্দ আর আবেগে ভেসে যাওয়ার উচ্ছাসটুকু  দেখার জন্যই এতটা পথ পাড়ি  দিয়েছি। সেটা এভাবে নষ্ট হতে দিতে চাচ্ছিলাম না। তোমাকে মেসেজ পাঠালাম “ঠিক এই মুহুর্তে তুমি কোথায়? তুমি কি তোমার উনিভার্সিটিতে?” আমি একটা বড় কাঁচের জানালার পাশে বসে তোমার ফিরতি ম্যাসেজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ২ মিনিট এর মাঝেই তোমার দীর্ঘ ম্যাসেজ। “আমি উনিভার্সিটিতে। তুমি কোথায় ছিলে? তোমার সেল অফ। তোমার বাসার ফোন ধরেছে ডেমিয়েন। তোমার অফিসে আমি কল করেছিলাম। তারা আমাকে বলেছে তুমি ছুটিতে গ্যাছ। ডেমিয়েনও বলতে পারেনি তুমি কোথায়! আমাকে কেন জানাও নি? তোমার ফোন বন্ধ কেন? আমাকে এখনই কল ব্যাক কর?” আমি তোমার উনিভার্সিটির ঠিকানাটি বের করে নিলাম ইন্টারনেট থেকে। ট্যাক্সি বুথে ঠিকানা দেখাতেই বলল এখান থেকে ১ ঘন্টার ড্রাইভ। আমাকে জিগ্গেস করা হলো আমি নিজে ড্রাইভ করবো কিনা। সে জন্য আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটি লাগবে। আমি পথ চিনিনা, শুধুই ঝক্কি বাড়বে তাতে। তার চেয়ে বরং ড্রাইভার চালানো টেক্সীতেই উঠে পড়ি।

কতদিন পর দেখা হবে। কতটা আবেগ জমেছে এত দিনে। না দেখার কতগুলি প্রহর পেরিয়েছে। কতটা অপেক্ষা আর কতটা প্রতিক্ষা নিয়ে আমরা পথ চেয়েছিলাম। কতগুলি অভিমানে পাশে থাকা হয়নি আমাদের। কতবার কেঁদে কেটে চলে আসতে চেয়েছ তুমি সাউথ পার্কে। আমি কতটা আনন্দিত আর উচ্ছাসিত বাইরের মেড়মেড়ে একঘেয়ে ঠান্ডা প্রকৃতিও জানে না। আমি এই অচেনা শহরে ছুটে চলেছি একজোড়া অভিমানী ডানার এক রাশ উচ্ছাসে আমার দুই বাহুতে ভেঙ্গে পড়ার আশা বুকে চেপে …. আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত …..

*সংযুক্তি : পেত্রভানিয়ার দিনগুলি ঃ দ্বিতীয় খন্ড
পেত্রভানিয়ার দিনগুলি ঃ তৃতীয় খন্ড

Share your thoughts