তোমার জন্য অপেক্ষা …
তেশরা অক্টোবর ২০১১ এর এক উজ্জল ভোরে আমি এস্কয়ার হসপিটাল এর লেভেল ৩-এ অপেক্ষা করছিলাম। যুঁথীকে কিছুক্ষণ আগেই আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমে নিয়ে গেছে। কিছুটা উদ্দিগ্নতা নিয়ে বসে ছিলাম। বেশ কিছু সময় চলে যাওয়ার পর চেকআপ রুম থেকে কোনো খবর না আসায় উদ্দিগ্নতা কিছুটা বেড়ে গেল। একবার উঠে ডেস্ক এ ডিউটি নার্স কে জিগ্গেস করলাম যুঁথীর আল্ট্রাসনোগ্রাম আর কতক্ষন লাগবে। কিছুটা এলোমেলো উত্তর দেয়ার পর আমি নার্স এর কাছ থেকে সরে এলাম নিজের আসনে। আরো কিছুক্ষন পরে আরেকজন নার্স এসে আমরীন রাশিদার সাথে কে এসেছে তা খোঁজ করা আরম্ভ করলো। আমি হটাৎ আরো উদ্দিগ্ন হয়ে গেলাম। আমি সাথে সাথে উঠে নার্স এর সাথে চেকআপ রুমে দিকে যেতে থাকলাম। ভেতরে যুঁথীকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হচ্ছে তখনো। একটা মনিটর এর দিকে তাকিয়ে আমি সব কিছু ভুলে গেলাম ক্ষনিকের জন্য।
আমি আমার অনাগত সন্তান কে দেখলাম প্রথমবার এর মত। আমার প্রথম সন্তান। চেকআপ রত ডক্টর মনিটর এ অনেক গুলি ফুটেজ আমাকে নানা ভাবে বিশ্লেষন সহকারে বুঝানো শুরু করলেন। হটাৎ একটা অপার্থিব ভালোলাগা সব কিছু ভুলিয় দিল আমাকে। ডক্টর এর কথা ভালো ভাবে শুনছিলাম না, আমি শুধু মনিটরের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ক্ষনিকের জন্য হলেও আমার অনুভুতি হচ্ছিল আমি হয়ত স্বর্গের কোথাও দাঁড়িয়ে আছি আর আমার সামনে আমার সন্তান। সদ্য ভ্রুন থেকে একটু একটু করে একটি নবজাতক এ রূপ নিচ্ছে। সে গুটি শুটি মেরে শুয়ে আছে তার ক্ষীন হাত বুকের উপরে ভাঁজ করে রেখে। পা গুলি আরো ক্ষীন লাগছিল আর ভাঁজ করে সে প্রায় তার বুকের কাছে গুটিয়ে রেখেছিল। খুব েছাট মুখটি তখনো স্পষ্ট নয়। তারপরেও ডক্টর দুটি চোখের অবস্থান লোকেট করে দেখিয়ে দিলেন। ডক্টর এর একটা কথায় আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। ডক্টর বলল “বাচ্চা বেশ নড়া-চড়া করছে। বাচ্চা বেশ ভালো আছে”। এর পরেই আবার ডক্টর মনিটর এর দিকে নির্দেশ করে কি একটা স্কেল দেখিয়ে বলল এটা হচ্ছে বাচ্চার হৃদস্পন্দন। বলার সাথে সাথেই মনিটর এর স্কেল স্পন্দন শুরু করলো আর একটা মৃদু শব্দ আসলো হৃদস্পন্দনের। এক অসাধারণ অনুভুতি নিয়ে আমি আরেকবার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এই অনুভুতির সাথে আমার কোনো পরিচয় ছিলনা। এর কিছুক্ষন পরেই যুঁথীকে নিয়ে বেরিয়ে আসি হসপিটাল থেকে।
প্রচণ্ড অনাকাঙ্খিত হলেও হটাৎ একটা কথা মাথায় ঘুরতে শুরু করলো। কি যেন কি কারনে মনে হলো বাচ্চাটা খুব একলা মন খারাপ করে অপেক্ষা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কি যেন একটা নিসঃঙ্গতা নিয়ে সে একা একা ঘুমোচ্ছে। হটাৎ মনে হলো যেন আমি আমার ছায়া দেখালম নিজের চোখে। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছিল কেন জানি। আমি চাইনা অনাগত এই সন্তান যেন কোনভাবেই আমার এই অন্ধকার দিকটা না পায়। প্রচণ্ড নিসঃঙ্গতা নিয়ে আমি সারাটা জীবন নিজের সাথে এক অসম যুদ্ধ করে গেছি। আমার সন্তান যেন কোনভাবেই আমার এই অন্ধকার ও অসীম ক্লান্তিকর এই দিকটি না পায়। পরম করুনাময়ের কাছে প্রাথনা করি সে যেন খুব সাধারন আর স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে। তাকে যেন নিজের একাকিত্বের সাথে কখনই যুদ্ধ করতে না হয়। সবকিছু ভুলে আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি।
2 Comments
Join the discussion and tell us your opinion.
Nice …… 🙂
Thanks for reading