উত্তরবঙ্গ ১১৩০ কিলোমিটার
২০১৪ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখ, তখনও ভোরের সূর্য ওঠেনি। মোবাইলে এলামর্ বেজেছে মাত্র ১ বার। তাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। মাথা বেশ ভারি লাগছে। চোখের পাতাও টেনে খুলতে পারছিনা। ঘুমিয়েছি মাত্র ২ ঘণ্টা। প্রতিটা যাত্রার আগেই আমার এমন হয়। ঘুম পালিয়ে যায়। গতরাতে প্রায় অনিচ্ছা সত্ত্বে ঘুমুতে গেছি। ঘুমানোর আগে ২ টা মোবাইলেই এলামর্ কনফার্ম করে নিয়েছিলাম। যাতে কোনভাবেই সকালে দুর্ঘটনা না ঘটে যায়। যদিও দুর্ঘটনার কিছু নেই। আমরা যখনই যাত্রা শুরু করব গাড়িও তখন ছাড়বে। মানে ট্রান্সপোর্ট তো যথারীতি আশিকের মোটর সাইকেল! তারপরেও যাত্রা পথের কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখার জন্য সকাল ৫ঃ১৫ মধ্যে রওনা দেয়া জরুরি। সকালে আশিককে ফোন দিয়ে উঠানটাই চ্যালেঞ্জ। গতবারের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে!
আমরা দক্ষিণে কুয়াকাটায় বঙ্গোপসাগরের সৈকত ছুঁয়ে ফেরার পথেই ঠিক করেছিলাম পরের যাত্রা তেতুলিয়ায় বাংলাদেশের সীমান্তের শেষটা। গুগুল ম্যাপ আর অন্যান্য ডকুমেন্ট ঘেঁটে আপ ডাউন দূরত্ব পাওয়া গেল প্রায় এক হাজার কিলোমিটারের কিছু কম বেশি। পুরো পথের সম্ভাব্য যাত্রা বিরতি ও অন্যান্য সুবিধা অসুবিধা নিয়ে আমি আর আশিক কয়েকবার আলোচনা করে নিয়েছিলাম আগেই। যদিও তাতে আসল যাত্রার সাথে তেমন কিছুই মিলেনি। পুরো পথটাও আমাদের কাছে প্রায় অচেনা। যদিও আমি উত্তরবঙ্গে এর আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। তবু এভাবে নিজ উদ্যোগে পথ খুঁজে যাত্রা এবারই প্রথম। সবকিছু ঘুছিয়ে রেখেছিলাম আগেই যাতে সকালে তেমন কোন ঝামেলা না হয়। আশিক এবার বেশ সময়মত হাজিয়ে হয়ে গেল বাইক নিয়ে আমার বাসার নিচে। আমরিন এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলাম। বাইরে প্রায় অন্ধকার। আশিক আর আমি মুখোমুখি হতেই বেশ একটা আনন্দের রেশ নেমে এলো। আমরা শেষ পর্যন্ত যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি।
বাতাসের আদ্রতা অনেক বেশি তার থেকে দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দেখা দিচ্ছে প্রায় অন্ধকার মেঘলা আকাশ। মোবাইলে ওয়েদার রিপোর্ট দেখাচ্ছে ঢাকায় বাতাসের গতি ৩ কিলোমিটার আর সাথে বৃষ্টিপাত। আমরা সিধান্ত নিলাম দ্রুত ঢাকার বাইরে বেরুতে হবে বৃষ্টিপাত এড়াতে। একবার কুড়িল ফ্লাইওভার এ দাঁড়ালাম একটা ছবি তোলার জন্য। এর পরে এক টানে সাভার। সাভার মহাসড়কে এত সকালেই বেশ ভিড় গাড়ির আর মানুষের। চারপাশে শুধু শিল্পাঞ্চল। সাবধানে চালাতে হচ্ছে। আকাশ এখানে চমৎকার রূপ ধারণ করেছে। হাল্কা ধূসর মেঘের সাথে উজ্জ্বল নীলচে আকাশ যেন পোট্রেইট এ কোন তুলির কম্বিনেশন। আমরা ছুটে যাচ্ছি। ঘড়িতে সময় কত খেয়াল নেই। কালিয়াকৈর পেরিয়ে বংশী নদীর উপড়ে ব্রিজ পেরিয়ে গেলাম। এখানে মেঘলা সকালে জনপদের আলস্য কাটেনি। কিছু মানুষ দ্রুত পায়ে কর্মস্থলে চলে যাচ্ছে মহাসড়কের ধাঁর ঘেঁষে। কখনও কখনও রাস্তার দুই ধারে সংরক্ষিত বনাঞ্চল চোখে পড়ছে। সূর্যের আলো ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে বনের ফাঁকে। সব থেকে ভালো ব্যাপার যে আমাদের বৃষ্টির সাথে দেখা হয়নি এই যাত্রায়।
আমরা গড়ে ৮৫-৯০ কিলোমিটার গতিতে যাচ্ছি। টাঙ্গাইল ও এলেঙ্গা পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকায়। এখানে প্রথম যাত্রা বিরতি করলাম আমরা। আমরা সেতুর পেট্রল রোডে ঢুকে যমুনার পারে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম আর ছবি তুললাম। এখানে বলে রাখা ভাল প্রতি যাত্রা বিরতিতে আশিক নিদেন পক্ষে ৩-৪ টা সিগারেট শেষ করত। আর সাথে থাকত আধা লিটার চা। বঙ্গবন্ধু সেতুর উপরে আমরা ছবি তুললাম কিছু। এর পরে আমরা সিরাজগঞ্জের এলেঙ্গায় অ্যারিস্ট্রক্রাট এ নাশতা সেরে নিলাম। যমুনা সেতু পার হয়ে প্রথম যে ভুলটা আমরা করলাম সেটার মাশুল দিতে হল ৮০ কিলোমিটার পথ অতিরিক্ত ঘুরে। আমরা ঘোরা পথে চলে গেলাম ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫০৭ ও ৬ ধরে যেটা চলে গেছে সিরাজগঞ্জ ও নাটোর হয়ে রাজশাহী! নাটোর পর্যন্ত পৌঁছে হটাৎ আমাদের মনে হল আমরা একটু রাস্তা সম্পর্কে জেনে নেই কারো থেকে। আর সেটা জানতে যেয়েই বিশাল একটা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেলাম। তা না হলে আমরা ৬ নম্বার ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে ঢুকে যেতাম রাজশাহী বিভাগে। সম্পূর্ণ উল্টো পথ। যাই হোক ভুল পথে যেহেতু এসেই গেছি তাই আবার প্রায় ৭০ কিলোমিটার পথ যাত্রা শুরু করলাম ৫০২ মহাসড়ক ধরে। মাঝে একবার থেমে কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে আমরা মাঝ দুপুরে পৌঁছে গেলাম বগুড়া। মাথার উপড়ে রোদের প্রচণ্ড উত্তাপ। পিচ গলা রোদের খড়দাহ। ছুটন্ত বাইকে বসে গরম বাতাসের হল্কায় বেশিক্ষণ দম নেয়া যায় না। নাক মুখ ঢেকে নিয়েছি। রাস্তার দুই ধারে ফসলের ক্ষেত আর গ্রাম। মনে হচ্ছে আমরা ছাড়া আর সব কিছুই এখানে থেমে আছে। সূর্যটাকে একেবারে মাথার উপড়ে রেখে পথ চলছি। সাবধানে চালাতে হচ্ছে কারন এখানে সড়ক বেশ সংকীর্ণ। উত্তর বঙ্গের সহজ সরল প্রাণ মানুষেরা (!) বেশ নির্বিকার চিত্তে রাস্তায় হাঁটে আর পাড় হয়। উত্তরবঙ্গের গৃহপালিত প্রাণীদের জন্যও একই কথা। তারাও বেশ রাশভারী রাজকীয় উদাসীন ভাবগাম্ভীর্য নিয়েই রাস্তায় ঘোরা ফেরা ও পারাপার হয়। তাই একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতেই হচ্ছে। বগুড়া থেকে আমরা এবার মহাসড়ক ৫৮৫ ধরে এগুতে থাকব আজকের দিনের মত সর্বশেষ গন্তব্য দিনাজপুরে। সূর্য কিছুটা হেলে যাচ্ছে। পথ প্রায় দেড়শ কিলোমিটার। আমরা বিরামপুর ও ফুলবাড়ি হয়ে দিনাজপুর ঢুকে যাব। মাঝে মাঝে পথের পাশে হাট-বাজার আর দোকান পাট। আমরা পরে একটা বাজারে থেমে জিলাপি আর চা খেলাম। আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছি সেটা বুঝতে পারছি। আমি আশিক কে বেশি ঝুঁকি নিতে না করি। এবার আর তাড়াহুড়ো নেই কোন। রাস্তার দু ধারে ধান, আখ, ভুট্রা আর সবজির ক্ষেত। দেশের খাদ্যশস্যের সব থেকে বড় যোগানদাতা এই উত্তর বঙ্গের বিস্তীর্ণ এই ফসলি মাঠ গুলি। কিছুদূর পর পর দেখা মিলবে বিশালাকার সব কোল্ড স্টোরেজ এর। মাইলের পর মাইল বাইকে একনাগাড়ে বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে উঠতাম। শেষ বিকেলে মহাসড়কের মাঝে এক মায়াবী আলোছায়ার খেলা খেলে যায়। আমরা বাইক থামিয়ে আবার কিছুক্ষন এই পরিবেশ উপভোগ করি। এখান থেকে আর প্রায় ৬০-৭০ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর জেলা শহর।
দিনাজপুরে যখন পৌঁছে যাই তখন মাত্র শহরে সন্ধ্যা নেমেছে। লোকে গম গম করছে শহর। কিছুটা এলোমেলো ধাঁচের পুরনো বাড়ি ঘর। চারদিকে অগোছালো আর অপরিছন্ন শহর। শহরে রাস্তা গুলি সরু আর একটু পর পর বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। আমরা খুঁজে একটা মোটামুটি রাতকাটাবার মত হোটেলে উঠে গেলাম। হোটেলের রুমে ঢুকেই বিছানায় পরে গেছি আর যেন কিছুতেই ওঠার শক্তি নেই। রাতের খাবারের অর্ডার করে আমি গেলাম বাইরে এটিএম থেকে টাকা তোলার জন্য। আবারও বিপর্যয়। ৫-৬ টা এটিএম ঘুরেও টাকা তোলা গেল না। পরে ঢাকায় এসে জেনেছিলাম এটা ব্যাংকের সফটওয়্যার আপডেট হওয়ার কারনে সার্ভার ডাউন ছিল। সে যাই হোক রাতের খাবার খেয়েই আমরা ঘুমিয়ে যাই। এখানে আরকটু বলে রাখি দিনাজপুরে খাবারের মানও ভালো ছিল না। যাওয়ার পথে রাতের খাবার ও ফেরার পথে দুপুরের খাবার আমরা এই শহরেই সেরেছিলাম।
১১ই এপ্রিল শুক্রবার, আমরা যাত্রা শুরু করি আমাদের সর্বশেষ গন্তব্যস্থল বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরের উদ্দেশ্যে। সকালে ঘুম থেকে উঠি প্রায় ১০টার দিকে। রেডি হয়ে দ্রুত নাশতা সেরে আমরা আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। এখানের মহাসড়ক বেশ প্রশস্ত আর মসৃণ। ছুটির দিন থাকায় রাস্তায় ভিড় কম। আমরা প্রায় আনুপাতিক হারে ৯৫-১০০ কিলোমিটার বেগেই বেশি চালিয়েছি। ২-১ টি বিরতি নিয়ে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে যাই বাংলাবান্ধা। উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশের খুব কাছাকাছি বাংলাদেশের সর্বশেষ সীমান্ত। দু’দেশের সীমান্ত দিয়ে পাথর বাহী ট্রাক পারাপার হচ্ছে। একটা ছাউনির নিছে বসে একজন সরকারি কর্মকর্তা কাগজপত্র তদারকি করছে। বর্ডার গার্ড এর কয়েকজন সৈন্য বসে আছে। একমাত্র ভ্রাম্যমান একটি দোকান আছে। কি যেন বিক্রি করছে। বেশ কিছু পর্যটকও দেখালাম, যারা এখানে ঘুরতে এসেছে। কেউই দাঁড়াতে পারছেনা প্রচণ্ড গরমের কারনে। সবাই বিশেষ “শুন্য” ভাস্কর্যের সাথে ছবি তুলে চলে যাচ্ছে। আমরাও তুল্লাম কয়েকটি ছবি। আর দেরি করার কোনও কারন নেই। এবার ফিরতি পথ ধরতে হবে।
এবার আমরা একনাগাড়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটারের ও বেশি পথ ছুটবো। গন্তব্য বগুড়া। এখানেই আমরা রাতে যাত্রা বিরতি দিয়ে ঢাকা ফিরে যাব ১২ তারিখ। বগুড়াতে আমরা ছিলাম পর্যটনের একটি মোটেলে। পরিবেশ বেশ ভাল। সব থেকে আশ্চর্য হয়েছি ডিনারে খাবারের মান দেখে। একটা সরকারি পরিসেবা কেন্দ্রে এত চমৎকার খাবার ও এত আন্তরিক সেবা যা আমারদের কল্পনার বাইরে ছিল। সব শেষে আশিক কে ধন্যবাদ তার এই উদ্যোগ নেয়ার সাহস করার জন্য। এতটা পথ ক্লান্তিহীন, অটল মনোবল, দায়িত্বপূর্ণ ও নিরাপদে পাড়ি দেয়ার জন্য। আমরা দুজনই একটা কথা বলেছি বার বার …
“একটা জীবনকে পুরোটা জানার জন্য একবার বেঁচে থাকা যথেষ্ট নয় তাই বেঁচে থাকার আনন্দটা আমরা যেন ভাগ করে নেই”