আলিওশার স্মৃতি (চিঠি – ১২)
প্রিয় জয়ন্তী,
ভেবেছিলাম আলিওশার গল্প আর বলা হবে না তোমাকে। কি জেন কিসের ভাবনা আমাকে পেয়ে বসে মাঝে মাঝে। জীবনের এই অসাধারণ গল্প গুলি আমার বেঁচে থাকাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। তাই হয়তো আবারো তোমাকে লিখছি।
ফেডারেশন নর্থ এর একেবারে মাঝ বরাবর ছোট একটা লেক বয়ে গেছে। সাপ্লাই হাব থেকে দুপুর নাগাদ বেরিয়ে এসেছি। গত রাত থেকে একটানা কাজ করে গেছি। বিকেলেই দেখা করার কথা। একটু আগে বের হওয়ার জন্য এই ঝক্কি নিতেই হল। গত সপ্তাহে কথা হয়েছিল আজকে সেন্ট্রালের কোথাও আমাদের দেখা হবে। বাইরে বেশ রোদ। সব কিছু তেতে আছে গরমে। ফিলেট্রার এর ঠিকানা টা মেসেজে আরেকবার দেখে নিলাম। এটাই তোমার পাঠানো ঠিকানা। আমই খুব বেশি যাইনি এই দিকটায়। রাস্তা আমার চেনা নেই। ট্যাক্সির ড্রাইভারই ভরসা। ট্যাক্সি ওয়ালা বেশ অভিজ্ঞ মনে হচ্ছে। ঠিকানা দেখাতেই বেশ হাল্কা দুলে গাড়িতে উঠে পড়তে বল্ল। যাক শুরুটায় গড়মিল নাই তাহলে। আজকে বেশ গরম। সূর্য তেঁতে আছে। মাত্র দুপুর গড়িয়েছে। এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে মাত্র ২০ মিনিটেই পৌঁছে গেছি। একেবারে নির্ভুল আবির্ভাব। কিছুটা আগেই পৌঁছে গেছি সন্দেহ নাই। রেস্টুরেন্টটা আকৃতির দিক দিয়ে বেশ ঢাউস। আমি ভিড় বাঁচিয়ে দোতলায় এক কোনায় জানালায় পাশে বসে পড়ি। একটা মেসেজ দিয়ে রাখি “আমি পৌঁছে গেছি”। জানালার নিছে বাইরে লাগোয়া রাস্তা দেখা যাচ্ছে। মানুষ আঃর যানবাহনের বেশ ভীড়। বৃষ্টিতে ভিজলে কাক ভেজা বলার একটা প্রবাদ আছে রোদে পুড়লে কি বলা যায় ? রোদ পোড়া ! রোদ পোড়া মানুষ গুলি ঘামে ভিজে ধ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। সবার মুখেই একটা ক্লান্তির অভিব্যাক্তি। হটাত মোবাইল বেজে উঠলো। আলিওশার কল। একটু সন্দেহ আঃর একটু উৎকণ্ঠা নিয়ে ফোনটা ধরলাম। শুধু মাত্র ১টাই কথা। আমি পৌঁছে গেছি প্রায়। আর জাস্ট ৫ মিনিট। যাক ও আসছে। অপেক্ষাটা এবার একটু জমে উঠছে কিসের জেন এক নিশ্চয়তায়।
আমি আবার জানালা দিয়ে বাইরে দেখছি মনোযোগ দিয়ে। এর মাঝে ওয়েটার বিশেষ লেমনয়েড দিয়ে গেছে। এটা নাকি এদের বেশ প্রসিদ্ধ। রাস্তার অপর পাশে এক অন্ধ লোক এসেছে। তার রাস্তা পাড় হওয়ার কৌশলটা দেখার ইচ্ছা হচ্ছে। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি। ভদ্রলোক শিধান্ত নিতে পারছে না। ছড়িটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক সেদিক মাথা ঘুরাচ্ছে। হটাত আমার চোখ আটকে গেলো এক টুকরো কালো কাপড়ের দিকে। একটা শাটল স্কুটার থেকে এক ফালি কালো কাপড় বাতাসে উড়ছে। আর এক জোড়া সরু ভরাট পায়ের কিছুটা দৃশ্যমান হচ্ছে। স্কুটারটা একটানে সামনে চলে গেল। একটু বিভ্রম ছড়িয়ে গেল। আমার ভাবনায় ছেঁদ পড়ল। ক্ষণিকের জন্য হলেও আমি অন্যমনস্ক হয়ে আকর্ষণী পদযুগলের অধিকারিণীর কথা ভাবছিলাম। অবাক করা বিষয় হল ক্ষণিক বাদেই আবার উল্টো পথ ধরে সেই কালো পোশাক ধারিণী সেই স্কুটারে ছুটে চলে গেলো যেদিক দিয়ে এসেছিল। আমি আলস্যে এইভাবে আসা যাওয়ার মুহূর্ত পাড় করছি। মোবাইলে সময় দেখে নিলাম ৫ মিনিট পেরিয়ে গেছে। আলিওশা কি চিনতে পারছে না জায়গাটা। নাকি সে হটাত সিধান্ত পরিবর্তন করেছে। এমনটা হবার কথা নয়। সে এখানটাতেই কোথাও থাকে আর সে নিজেই এই রেস্টুরেন্ট এ দেখা করার কথা বলেছে। তারমানে এটা তার পরিচিত স্থান। জানালা থেকে এবার মোবাইলে হাবের আপডেট নিলাম কিচ্ছুক্ষণ। হাবে কোথাও ঝামেলা হয়েছে নিশ্চয়ই। ১২ আর ১০৯ নাম্বার লাইন জ্যাম দেখাচ্ছে অনবরত। হটাত মোবাইলে আলিওশার কল ভেসে উঠলো।
– তুমি কি দোতলায়
হ্যা! তুমি এসেছ? কোথায় ?
– আমি নিচে গেটে, একটু কি এখানে আসবে।
-হা আমি নিচে আসছি অপেক্ষা কর।
দরজায় চোখ চলে যেতেই কিছুটা হকচকিয়ে যাওয়ার জোগাড়। কিছুক্ষণ আগে কালো ড্রেস পড়া যাকে আমি স্কুটারে দেখেছি সেই মেয়েটিই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে প্রায় অসামান্য নিখুঁত সুন্দর যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সেই অনিন্দ্য সুন্দর পায়ের অধিকারিণী !নিচের ঠোঁট কিছুটা মোটা। মুখে তির্যক হাসি। কিন্তু আমার মাথায় শাটল স্কুটার ঘুরছে। আমি সবকিছু ভজঘট পাকিয়ে দিলাম প্রথমেই। এমন কি প্রাথমিক শুভেচ্ছাটুকু জানাতেও ভুলে গেলাম। কিছুটা শঙ্কা আর দোটানা নিয়ে আবার দোতলায় জানালা লাগোয়া আগের সিটে বসলাম মুখোমুখি দুজনায়। সূর্য চলে যাচ্ছে অস্তাচলে। কালো ড্রেসের আড়ালে অনিন্দ্য সুন্দর পায়ের মেয়েটির কথা বলতেই কিছুটা জড়তা কাটার উচ্ছল হাসি। কিছুটা লজ্জা নিয়ে খানিকটা দেরির জন্য অনুতাপ ছড়িয়ে দিলে। প্রথম পরিচয়ের সেই দিন অনেক কথাই হয়েছিল। যার শুরু কিংবা শেষ কোথায় তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর আজ। ওভাবে একতা পরিচয় কতগুলি নিরেট ইটের মত আজো বুকের মাঝে বয়ে বেড়াতে হবে বুঝিনি কখনো। এখনো মনে পড়ে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বার বার আলিওশার পা দুটি দেখছিলাম। আলিওশা খুব সহজাত ভঙ্গিতে বার বার আমাকে নিঃসঙ্কোচ করার চেষ্টা করে গেছে। অনেক্ষন গল্প শেষে যার প্রায় পুরোটাই আমি নির্বাক থেকেছি। যা কিছু বলেছিলাম তার প্রায় সব গুলোই কৌতূহল মেটানোর জন্য করা কিছু প্রশ্ন। কিছু খুব সাধারণ জানতে চাওয়া। ও সন্ধ্যা নামতেই নিজ থেকেই আমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে চাইল। আমরা ঘণ্টা খানেক একটা শাটলে ঘুড়ে বেড়ালাম।
সহসাই জাহেরির নিঃসঙ্গতা আলিওশাকে পুরো পুরি গ্রাস করে নেয়। আলিওশা আর কখনো এই নিঃসঙ্গতার গ্রাস থেকে বের হতে পেরেছিল কিনা জাহেরির জানা হয়ে ওঠেনি। জাহেরি অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্প আমাকে বলেছিল। যেই গল্প গুলির সবটা জুড়ে একটা দীর্ঘ ভাঙ্গনের উপখ্যান। আমি জানি না এই গল্পগুলি তোমাকে হতাশ করবে কিনা। আবার হয়তো তোমাকে জাহেরির গল্প বলবো।