েফলে আসা শৈশব খণ্ড ঃ ৫
ছেবেলার কথা। তখন হয়ত চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। তখন আমার একজন খুব প্রিয় সহচর ছিল। নাম সোহাগ। আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। আমরা তখন শহীদ আলতাফ মেমোরিয়াল স্কুল এ পড়ি। আর্থিক অবস্থার দিক দিয়ে সোহাগের পরিবার কিছুটা দুস্থ অবস্থায় ছিল। তখন তার জীবন এর একমাত্র লক্ষ্য ছিল লঞ্চ এ চাকরি করা। মাঝারি আকৃতির হালকা পাতলা গড়নের সোহাগের স্কুল ভালো লাগত। কিন্তু সে তখনই নিশ্চিত ছিল তার ক্লাস টেন এর পরে আর পরা লেখা করা হবে না। ওই সময়ে তার প্রভাব আমার উপরে বেশ ভালোভাবেই ছিল। তার একটা নমুনা দেই। সোহাগ এর প্রিয় শখের বিষয় ছিল রিক্সার বেয়ারিং এর বল সংগ্রহ করা। তার সংগ্রহে এই রকম প্রায় হাজার খানেক বল ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা আমাকে খুব আমাকে মুগ্ধ করে ফেল্লো। আমিও বেয়ারিং এর বল সংগ্রহ শুরু করলাম। স্কুল শুরু হবার আগে ও ছুটির পরে আমরা অভিযান এ নামতাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটি কিন্তু চোখ খুঁজে বেড়ায় বেয়ারিং এর বল। আমাদের প্রধান টার্গেট ছিল রিক্সার গ্যারেজ। এইখানেই পেয়ে যেতাম অনেক। পুরনো বেয়ারিং এর ফেলে দেয়া বল দেখলেই চোখ চক চক করে উঠত যেন। সংগ্রহের পরে বল গুলি ভাগা ভাগী করে নিতাম আমরা। দেখতে দেখতে আমার কাছেও প্রায় ১ কৌটা বল জমে গেল। সেগুলিকে নাড়া চাড়া করতে ভীষণ আনন্দ পেতাম সেকথা এখনো মনে আছে।
বল ছিল দুই ধরনের, একটার আকার কিছুটা বড় আরেকটার আকার খুব এ ছোট। বল গুলি শুধু সংগ্রহ করলেই চলবে না সেগুলির জন্য চাই বিশেষ যত্ন। তা না হলে কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলিতে মরচে ধরে চক চকে রুপালি ভাব নষ্ট হয়ে যাবে। বল সংগ্রহ আর সেগুলির পরিচর্যার সব কিছুই চলত বিশেষ সাবধানতার সাথে লুকিয়ে। আঁচ করতে পেরেছিলাম আমার এই বল সংগ্রহ ব্যাপারটা যথারীতি আমার মাকে আতঙ্কিত করেছিল। তার ধারণা ছিল আমার সোনালী ভবিষ্যত এর সব স্বপ্ন শেষ। যে ছেলে রিক্সার বল নিয়ে খেলে তার ভবিষ্যত রিক্সাওলা তেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবিক অর্থেই সীমাহীন দুঃক্ষজনক ভবিষ্যত। যদিও সেই সময়ে মায়ের সেই সন্দেহের সাথে আমার বিশাল মতপার্থক্য।
যাই হোক আমার রিক্সার বল এর সংগ্রশালা ও রক্ষনা বেক্ষণ এর কাজ চলত বাসার একতলা লাগোয়া ছাদে। মাঝে মাঝে ছাদে বসে বলগুলি কৌটা থেকে বের করে নিবিড় মনোযোগ দিয়ে গুনতাম আর কেরোসিন তেল দিয়ে ভিজিয়ে রাখতাম। কেরোসিন তেল এর বিশেষ অপকারিতা হলো সাবান দিয়ে ধুলেও গন্ধ থেকে যায়। যথা রীতি মায়ের কাছে ধরা পরার সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়। যখন আমরা বরিশাল ছেড়ে ঢাকা চলে আসি তখনও বল গুলি ছিল আমার কাছে ছাদের একটা বিশেষ গোপন জায়গায় সেগুলি রেখে দিয়েছিলাম। এখন অবশ্য গোপন জায়গার নাম বললে ক্ষতি কিছু নেই। জায়গাটা ছিল পূর্ব পাশের সানসেট এর উপরে। সেখানে কৌটা রাখাটা একটু ভয়ের ছিল। পিছলে গেলে নিচে পরে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ছিল। পরে আমি অনেক বার বরিশাল এ আমাদের সেই বাড়িতে গেছি কিন্তু সানসেটের ঐ জায়গাটার কথা আর মনে পড়েনি কখনো।
আবার সোহাগের গল্পে ফিরে আসি। তো একদিন একটা অকুতভয় কাজ করেই ফেললাম। সোহাগকে বাসায় নিয়ে আসলাম। জানতাম মা নাখোশ হতে পারে এই ভেবে যে, আমি এখনো এই বিচিত্র ছেলের সাথে দিন কাটাচ্ছি। অবাক করা ব্যাপার হলো আমার থেকেও আমার মায়ের কৌতুহল বেশি দেখলাম সে মুহুর্তে সোহাগের উপর। সোহাগ এর সব খবর সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিচ্ছে। তাকে আমার সাথে ভাত খেতে দেয়া হলো। সে নিসংকোচে অনেক তৃপ্তি নিয়ে ভাত খেল। সোহাগ চলে যাওয়ার সময়ে একটা কথা বলেছিল “তোর মা অনেক ভালো, তোরে অনেক আদর করে”। সোহাগের এই কথার তেমন কোনো বিশেষ তাতপর্য সেদিন আমি বুঝিনি। আমার তো জানাই ছিল আমার মা-ই পৃথির সব থেকে ভালো মা।
স্কুল পরিবর্তন করে বরিশাল জিলা স্কুল এ চলে যাই এর পরে। সোহাগ এর সাথে হঠাৎ আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। সোহাগ আমার জীবন থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যায়। এখনো মাঝে মাঝে সোহাগকে দেখতে ইচ্ছে করে।