নিঃস্তব্ধ – নিঃসঙ্গ পাহাড়ে

বাংলাদেশের পূর্বের দূর্গম পাহাড়ের গল্প বলি। আমার সবসময়ই মনে হত এই পাহাড়ী এলাকা হয়তো  জনমানব বিবর্জীত আর ভয়ানক কোনো অশুভো জায়গা। এই রকম কেন মনে হয়েছিল তা জানি না আজও। যদিও ধীরে ধীরে জেনেছি এই পাহাড় গুলি অনেক মানুষের আশ্রয় স্থল। সেইসব মানুষ যারা এই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী। নানা ধরনের মতামত ও মতবিরোধ থাকা সত্তেও যাদেরকে আমরা উপজাতী হিসেবে চিনি। এই আলোচনায় আজ নয় পরে আসা যাবে।

আমি আমার পাহাড় পাড়ি দেয়ার গল্প বলি। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে বহু স্থান ঘোরা হলেও কোনো এক বিচিত্র কারণে বান্দরবান যাওয়া হয়নি আমার কখনো। বহুবারই সুযোগ তৈরী ছিল। কি জানি কি বিচিত্র কারণে কখনই যাওয়া হয়নি। ২০১২ এর নভেম্বরের শেষের দিকের কথা। বন্ধু আশিক, তানিম, মর্তুজা আর স্বপন ভাই মিলে পরিকল্পনা করে পাহাড়ে যাওয়ার। বরাবরের মত এবারও সুযোগ এলেও আমি পরিকল্পনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই। একেবারে শেষ মুহুর্তে আমি দলটির সাথে যুক্ত হই। এই দলটির একমাত্র পাহাড়ে ভ্রমণের পূর্বাভিজ্ঞতা ছিল স্বপন ভাইয়ের। তিনি এর  আগে ২-৩ বার ঘুরে এসেছেন দূর্গম এই পাহাড়ী অঞ্চল। সেই হিসেবে আমরা স্বপন ভাইকে দলের প্রধান ও নির্দেশক হিসেবে নির্বাচন করি। যদিও স্বপন ভাই পুরো অচেনা দুর্গম ও বিপদ সংকুল ভ্রমনে আমাদের কে সার্বিক সহায়তা ও নির্দেশনা দিয়ে ট্রেকিং শেষে নিরাপদে সমতলে নিয়ে আসেন।

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে রওনা দিয়ে আমরা ঠিক স‍ূর্যদয়ের আগেই বান্দরবনের উপকন্ঠে পৌঁছে যাই। ভোরের কুয়াশা ভাঙ্গার আগেই আমরা প্রবেশ করি বান্দরবান প্রধান শহরে। হালকা নাশতা সেরে, বান্দরবান শহর থেকে আমরা একটা মিলিটারির পরিত‍্যাক্ত গাড়ি ভাড়া নেই রুমা বাজার পর্যন্ত। আমরা দুপুর এর আগেই রুমা বাজারে পৌঁছে যাই। বাংলাদেশ মিলিটারির তৈরী এই রাস্তা গুলি বেশ চমৎকার। মোটামুটি ভাবে তারা নিরাপত্তার দিকটি নিশ্চিত করেছে রাস্তা গুলি তৈরির সময়ে। বান্দরবান থেকে রুমার পথে পথে পাহাড় আর পাহাড়ি বাঁকের সর্পিল পথ।  মাঝে ছোট ছোট ইস্পাতের সেতু পার হয়ে গেছে কোনো গিরিখাঁদ অথবা পাহাড়ি নদী। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে আমরা ধীরে ধীরে সমতল থেকে উপরে উঠে যাচ্ছি। ভ‍্যালির মত একটা  খোলা জায়গায়  আমরা সবাই নেমে গেলাম গাড়ি থেকে ছবি তোলার জন্য। যেখানে এক দিকে পাহাড়ের দীর্ঘ ছায়া আড়াল করে আছে পাহাড়ের একপাশ আরেক পাশে সকালের চনমনে রোদ এসে কুয়াশা মুছে দিচ্ছে। আমরা কিছু ছবি তুলে আবার রওনা দিলাম রুমার উদ্দেশে। সাঙ্গু নদীর উপরে নতুন ব্রিজ হয়ে গেছে। বেশ উচুঁতে এই ব্রিজের নিচে খরস্রোত হারানো ক্ষীন ধারা শীতের বহমান সাঙ্গু। ব্রিজের পরের বাকি পথ টুকু এখনো খুবই বিপজ্জনক। কোথাও রাস্তা একেবারে খাড়া উঠে আবার খাড়া নিচে নেমে গেছে। দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম রুমা বাজারে।

রুমা বাজারে আর্মি ক‍্যাম্প এ নাম তালিকাভুক্ত করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম বগা লেকের উদ্দেশ্যে। রুমা বাজারে আমাদের সােথ যোগ দেয় আমাদের গাইড মিশুক। ২৪ বছরের এই পাহাড়ি তরুণ যেন এক অমিত প্রাণ সম্ভারের  উৎস। দীর্ঘ যাত্রা পথের ক্লান্তি নিমিষেই উড়ে যায় তার দুরন্ত, আন্তরিক ও বন্ধুবৎসল ব্যবহারে। সে খুব দ্রুত আমাদের দলটির সাথে একাত্ত হয়ে যায়। আমরা আন্দাজ করতে পারিনি শুধু ইট বিছানো বাকি পথটা কত বিপদসংকুল আর রোমাঞ্চকর হতে পারে। একেকটা পাহাড়ে গাড়ি প্রায় খাড়া উঠে যাচ্ছে প্রচন্ড গতিতে আবার ওই সমান গতিতেই নিচে নেমে যাচ্ছে। সংকীর্ণ রাস্তার পাশে  গভীর গিরিখাঁদ। ছাদ খোলা এই জিপ গুলির লোহার রড ধরে বাদুরের মত ঝুলে পথ পারি দিতে হবে প্রায় পুরোটা। এমন সঙ্গিন পরিবেশকে আরো চানঞ্চল‍্য করে তুলতে মিশুক তার বিচিত্র রিমিক্স গান শুরু করে। পেছনে ফেলে আসা পাহাড়ের উপর থেকে অনেক দূরে দেখা যায় রুমা বাজারের দৃশ্যপট। দীর্ঘ পথ পািড় দিয়ে যখন আমরা বগা লেকের পাদদেশে এসে পৌঁছি তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল এক তিক্ত পরীক্ষা। সামনের উঁচু পাহাড় পেরিয়ে বগা লেকে যাওয়ার রাস্তা। আমরা শেষ পথ টুকু পেরুবার জন্য বেশ উৎসাহ নিয়ে যাত্রা শুরু করি পায়ে হেঁটে। বেশ কিছুটা পাহাড় বেয়ে হটাৎ আমি বুঝতে পারি আমার ফুসফুস যথেষ্ট বাতাস পাচ্ছে না। বুক ধরে আসে আর বসে পড়ি। মনে হচ্ছিল বাকি পথটা পািড় দেয়ার আর কোনো উপায় নেই। পরের দিনের কেওক‍ারাডং যাত্রার ব‍্যাপারটা আমার কাছে হঠাৎ ফিকে হয়ে যায়। আমি হঠাৎ সিধান্ত জানিয়ে দেই আমার দ্বারা কেওকারাডং যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি বগা  লেকেই অপেক্ষা করব পুরো দলের ফিরে না আসা পর্যন্ত। আমি আমার কাঁধের ব্যাগ মিশুকে দিয়ে তানিম এর সাহায্য নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। মনে হচ্ছিল পথ বুঝি আর শেষ হবে না। বুঝতে পারি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ফুসফুস  বাতাসের জন্য হাহাকার করতে থাকে। এভাবে পথ চলে ৩০-৪০ মিনিটের মাথায় আমরা বগা লেকে পৌঁছে যাই। পাহাড়ের শেষ ধাপ পেরুনোর সাথে সাথে চোখের সামনে খুলে যায় প্রকৃতির এক অসামন্য রূপ। সুদূরে দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ পাহাড় আর তার ঠিক নিচেই দীঘল জলের কাজল দীঘি (লেক)। শরীরের সব কষ্ট উঁবে যায় সহসাই। আবার আমরা মিলিটারী ক‍্যাম্পে নাম লিপিবদ্ধ করাই। লেকের ঠিক উপরেই এই ক‍‍্যাম্প এর অবস্থান। প্রায় ১৬-১৭ ঘন্টার বিরতিহীন কান্তিকর যাত্রা শেষে যখন আমরা লেকের পাশের ছোট্ট গ্রামে ঢুকি তখন হেমন্তের বিকেলের হালকা হিম বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। একটু পরেই সবাই দীঘল দিঘীর জলে গা ভািসয়ে দিই এক অপার প্রশান্তিতে।

যে যার মত বিশ্রাম নিয়ে রাতের বার্বিকিউ এর জন‍্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। মিশুক আমাদের জন্য পাহাড়ি মোরগ যোগাড় করে বেশ বড়সর একটা। বেচারা মোরগটার দিকে তাকিয়েই বন্ধু তানিম ফিদার কথা মনে পরে যায়। সে এই জাতীয় মোরগের বিশাল সমঝদার। সে যাই হোক এক পর্যায়ে তো আমাদের বার্বিকিউ এর চুলাই বেহাত হয়ে গেল আরেক পর্বতারোহী দলের দ্বারা। যদিও সেটা নিছক ভুল বোঝা বুঝি ছিল। আমার হয়তো কেওকারাডং যাওয়াই হত না যদি না এক বাঙালি গাইড আমাকে সাহস যোগাতো। সে আমার অনর্থক ভয়কে হেসেই উড়িয়ে দিল। আসলে তার ভরসাতেই আমি পরের দিন সকালে দলের সাথে আমি কেওকারাডং অভিযানে যুক্ত হই। তাকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়, হয়ত নিজের উপর অনাস্থার কারণে কেওকারাডং আর দেখা হোত না। রাতের আহার শেষে যে যার মত ঘুমিয়ে গেল সবাই। আমি আরো বেশ কিছুক্ষণ জেগে ছিলাম হিমশীতল পাহাড়ি নৈঃশব্দে।

খুব ভোরে স্বপন ভাই আমাদেরকে উঠিয়ে দিলেন প্রস্তুত হওয়া জন্য। একে একে সবাই প্রস্তুত হয়ে গেলাম। দোতলার টং থেকে নিচে নামার পরে মিশুক আমাদের সবাইকে একটা করে বাসের লাঠি ধরিয়ে দিল। উঁচু পাহাড়ে ওঠার জন্য এই ধরনের সহায়তাকারী লাঠি খুবই  দরকারী জিনিস। আমাদের সাথে নেয়া হলো পাঁকা পেপে,বিস্কুট আর পানি সকালের নাস্তার জন্য। অভিযানের প্রথম টার্গেট নির্ধারণ করা হলো চিংড়ি ঝর্না। চিংড়ি ঝর্নায় আমরা নাশতা করব। ভ‍্যালী থেকে অপেক্ষাকৃত কম দূর্গম পথ ধরে ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছি আমরা। একটা পর্যায়ে এসে পাহাড়ের বাঁকে দাঁড়িয়ে সুদূরে দেখতে পাই বগালেক। এখানে পাহাড়ী পথ তেমন বিপদজনক না হলেও সাবধানে পথ চলতে হয়। কিছু কিছু জায়গায় পথ খুব বিপদজনক হয়ে গেছে। পুরোটা পথই দূর্গম চড়াই উতড়াইয়ে ভরা। কখনো কখনো উঠে যেতে হয় একেবারে খাড়া পথ বেয়ে পাহাড়ে আবার সাবধানে পা ফেলে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে আবার আরেক পাহাড়ে উঠতে হবে। মিশুক যখন আমাকে বলছিল “আমরা এখন পাহাড় থেকে নেমে সামনের ওই যে দূরের পাহাড়টা দেখা যায় ঐটায় উঠবো” তখন চোখের সামনে যেন বিভীশিখা দেখি। টানা ২-৩ ঘন্টা পথ চলে পাগুলি একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছে। যখনই বেশি ক্লান্ত হয়ে গেছি তখন এ প্রকৃতির নৈসর্গ ক‍্যামেরায় ধারন করার অযুহাতে দাঁড়িয়ে পড়ি। সকালের কুয়াশা এখনো কাটেনি পাহাড়ে। বহুদূরের পাহাড় গুলির গায়ে এখনো কুয়াশার চাদর জড়ানো। চলতি পথের দুধারে চেনা অচেনা নাম না জানা অনেক গাছ আর লতা-গুল্মের ঝোপঝাড়।

 

 

 

 

১১:৪০ এ আমরা পৌঁছে যাই দার্জিলিং পাড়াতে। ছোট্ট আর নিভৃত এক পাহাড়ি গ্রাম। এখানে আরেকটা ছোট্ট যাত্রা বিরতি নেই আমরা। আমরা বিস্কুট, কলা আর চা পান করে নেই। বহুপথ আনাড়ি পায়ে হেঁটে পায়ের মাংসপেশী গুলি শক্ত হয়ে গেছে আমার। হটাৎ ভাবি কি করে এতটা দুর্গম পথ পাড়ি দিলাম, যেখানে প্রথম দিকে অভিযানে আসাটাই আমার জন্য অনিশ্চিত ছিল। আবার পা বাড়াই শেষ পথ টুকু পাড়ি দেয়ার জন্য। অনেক দূরে কেওকারাডং এর চূড়া দেখা যায়। এখানে রাস্তার দু ধারে বড় গাছপালা কম। মাথার উপরে সূর্যটা তেতে দিচ্ছে। রাস্তার ধারে জুম চাষীরা বাগান করছে।

ঠিক দুপুর ১২টায় আমরা পৌঁছে যাই কেওকারাডং এর চূড়ায়। ভেবেছিলাম এই পাহাড়ের চূড়া নির্জন হবে। পদার্পনের পর দেখি রীতি মত অবাক করা ব‍্যাপার। এখানে রীতি মত পিকনিক স্পট বানানো হয়েছে। মূল পাহাড়ের চূড়াতে একটা ওয়াচ টাওয়ার এর মত ইটের ছাউনি বানানো হয়েছে যেখানে ইটের বানানো কিছু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। সিঁড়ির পাদদেশেই সরাইখানা। আমরা পৌঁছুবার আগেই বহু অভিযাত্রী পৌঁছে গেছে। কেউ কেউ নিচের সরাইখানায় দুপুরের খাবার সারতে ব‍্যাস্ত। এই চূড়ার উচ্চতা নিয়ে নানা মতামত রয়েছে। তবে ৩১০০ ফুটের কিছু কম বেশি হবে। চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড়ের সারি। আমাদের ছবি তোলা, চা পান আর বিশ্রাম পর্ব শেষ হতেই আমরা আবার আমাদের সর্ব শেষ গন্তব্যের উদ্দেশ্য যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করি।

 

 

 

 

অভিযানের এই দ্বিতীয় পর্বের প্রতিকূলতার সাথে কেওকারাডং পর্যন্ত অভিযাত্রার কোনো তুলনাই চলে না। মিশুক ছাড়া আমাদের পুরো দলটির একমাত্র অভিজ্ঞ অভিযাত্রী হলো স্বপন ভাই। স্বপন ভাই এর আগেও বেশ কয়েকবার বান্দরবানের এই পাহাড় গুলিতে ঘুরে গেলেও জাদিপাই ঝরনায় তিনিও প্রথম যাচ্ছেন আমাদের সাথে। তাই বাকি পথের ধরন ও প্রতিকুলতা সম্পর্কে আমাদের মিশুকের অভিজ্ঞতাকেই পুঁজি করতে হবে। যদিও মিশুকের কাছে সব পাহাড় অভিযানই সহজ। জাদিপাই কেওকারাডং রেঞ্জ এর দক্ষিনের একটা অংশ। প্রায় বেলা ১ টার দিকে আমরা জাদিপইয়ের অভিমুখে যাত্রা শুরু করি। কেওকারাডং পেরিয়ে দক্ষিনে কিছু এগুলেই প্রথমে পরবে পাছিং পাড়া। পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। এখানে আছে বাচ্চাদের প্রাইমারি স্কুল ও খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের উপাসনালয়। কিছু ধাড়ি কালো শুেয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। লোকজন যথারীতি অনাহুত দৃষ্টি নিয়ে আমাদের যাত্রা দেখছে। ২-১টা ফটো তুলতে চাইলে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী হয়। গ্রাম পেছনে ফেলে আমরা জাদিপাইয়ের দিকে পা ফেলে হাঁটতে থাকি। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে।

এখানে লাল মাটির পাহাড় খাড়া নিচে নেমে গেছে। সাবধানে পা ফেলে ভারসাম্য রক্ষা করে নামতে হচ্ছে। সুদূরে পাহাড়ের একট লম্বা রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে, ওই রেঞ্জের একেবারে নিচের দিকে ঝরনা। আমরা ওই দিকেই যাচ্ছি। আমাদের কে ইতিমধ্যে কএকজন ঝরনা ফেরত অভিযাত্রী শুভকামনা জানিয়ে পাশ কাটিয়ে ফিরে গেল। তাদের কথা মতে এই যাত্রার শেষ অংশটা আরো ভয়াবহ দূর্গম। একটানা খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নামতে নামতে আমার পায়ের হাঁটু ধরে আসে। গন্তব্য অবধারিত যেতেই হবে। এক পর্যায়ে আমরা পাহাড় এর নিচে সমতল এর মত একটা জায়গায় চলে আসি। যার চার দিকটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এখান থেকে ঝরনা একেবারে কাছে। কান পাতলে ঝড়া পানির শব্দ শোনা যায়। আমরা একটা খাঁদের কিনারার মত জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। ২ জন অভিযাত্রী বিশ্রাম নিচ্ছিল। তাদের চোখে ক্লান্তির ছায়া। আমাদের কে বার বার সাবধান করে দিল। এই খাঁদ একেবারে বুক সমতল খাঁড়া হয়ে নিচে নেমে গেছে। একটু অসতর্কতা বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে! এও বলে দিল আমরা যেন কেউ কাউকে নিচে নামতে সাহায্য না করি। তাতে বরং বিপদ বাড়বে। এক কথায় ৪-৫ শত ফুট নিচে নামতে হবে কোনো রকম চলার পথ ছাড়া। কখনো গাছের ডাল ধরে, মাটি আকড়ে, মাটির খাঁজে পা দাবিয়ে পুরো পথ নিচে নামে গেলাম। এতটা পথ আসতে যতনা পরিশ্রম হলো তার থেকে বেশি পরিশ্রম হলো এই পথ টুকু নামতে।

ঝর্নায় নামতেই অসাধারণ সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলাম। বাংলাদেশের সবথেকে সুন্দর ঝরনা গুলির একটি এই জাদিপাই ঝরনা। বেশ উঁচু থেকে বড় আকারের পানির ধারা ছড়িয়ে নিচে পড়ছে। শীতের সময় বলে হয়ত পানি কমে গেছে। ঝরনার ডাউন প্লেটটা পুরোটাই স্লেট পাথরের। উপর থেকে পানি পড়ে নিচে একটা বেসিন এ জমা হচ্ছে। সেই পানি আবার আরেকটা স্টেপে ঝরনা হয়ে আরো নিচে চলে যাচ্ছে। বড় বড় বোল্ডার জমে আছে বেসিনের শেষ প্রান্তে। একটা বেশ চমৎকার রংধনুও উদয় হয়েছে ঝরনার পানিতে। বেশি দেরী না করে ঝর্নার বেসিনের হিমশীতল জলে ঝাপ দেই আমরা সবাই। বলা বাহুল্য প্রিয় মর্তুজা তার সতস্ফুর্ত কিছু বিনোদন দিয়ে পুরো ক্লান্তি দূর করে দেয়। দলের সবাই আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রায় আধাঘন্টা অতিবাহিত করে আমরা আবার ফিরতি পথ ধরি। পেছনে পরে থাকলো এক অমিমাংিসত সৌন্দর্যের ঘরছাড়ার ডাক। আমি জানি এখানে আমাকে আবার ফিরে আসতে হবে। আমি অনুভব করি জাদিপাইয়ের এই ঝরনা আমার স্মৃতির সবথেকে গভীরে ঝরতেই থাকবে। ঝরনাদের হয়তো এটাই নিয়ম।

ঝরনায় নামতে যতটা না কষ্ট হয়েছিল উঠা ততটাই সহজ মনে হলো। সবার আগে মিশুক উঠে গেছে। এর পরেই আমি উঠে গেছি, সাথে একে একে সবাই। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায়  পৌনে চারটার দিকে আমরা আবার সমতল পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করি। শরীর ক্লান্ত, দুপুরে খাওয়া হয়নি, পা গুলি এলোমেলো, মাথায় শুধু এখন একটাই ভাবনা কখন বগা লেকে ফিরব। নির্ধারণ করা হলো ফিরতি পথে কেওকারাডং এর সরাইয়ে খাব। দুপুরেই বলা ছিল যদিও। আমরা ২ জনের দল করে হাঁটছি। একটা দল ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিলে আরেকটা দল এগুতে থাকে। আবার ওরা যখন বিশ্রাম নেয় আমরা এগিয়ে ওদের ধরে ফেলি। এভাবে পথ চলে সূর্য ডোবার লগ্নে আমরা পাছিং পাড়া পৌঁছে যাই।

পশ্চিমের আকাশে তখন বেগুনি-লাল আভা। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে পাহাড় গুলি ঘুমিয়ে যাচ্ছে। পূর্বের পাহাড়ের এই নিঃসঙ্গ গ্রাম গুলিতে তীব্র শীতের রাত নেমে আসছে। কোনো একটা বাড়ির উঠোনে কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছে কিছু মানুষ। বাচ্চারা আর বৃদ্ধরা আগুন পোহাচ্ছে। আমি একটা বাচ্চা দেখলাম যার প‍্যান্ট নাই কিন্তু একটা ময়লা সোয়েটার গায়ে দিয়ে কুকুর সাথে নিয়ে ঘরের দেউড়িতে বসে আছে। কোথায় যেন একটা অস্ফুট নিঃসঙ্গ সুর বেজেই যাচ্ছে একটানা। বহুদিন পর যেন আমার ভেতরের নিঃসঙ্গতা হটাৎ আমাকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল পাহাড়ের ডাকে। আমি থমকে গিয়ে ভাবনার জল বুনতে থাকি। জীবনের প্রায় কিছুই না দেখা এই পাহাড়ি মানুষ গুলি কি নিভৃতে জীবন পার করে দিচ্ছে। জীবনের কাছে এদের খুব বেশি চাহিদাও নেই। এরা জানে না রাজহাসের গল্প কিংবা ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে ছোটা। আমার নিঃসঙ্গতার সাথে হয়ত এই নিঃসঙ্গ পাহাড় গুলির মিতালি হয় গেছে জেন। যেমন মিতালি হয়ে গিয়েছিল দক্ষিনের পাড় ভাঙ্গা পায়রা নদীর সাথে।

সন্ধে নেমে এসেছে আমরাও ফিরে এসেছি কেওকারাডং এর চূড়ায় ফিরতি পথে। এখানের সরাইয়ে খেয়ে নিলাম আমরা ঝটপট। এখন ফিরতে হবে বগা লেকে। এই অন্ধকারে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। আমাদের সাথে আরো দুটি বড় অভিযাত্রী দলের দেখা হলো। তারাও বগালেকে ফিরবে। এই বিপদ সংকুল যাত্রা পথে আমরা সবাই একমাত্র মিশুকের উপরে নির্ভর করছি। সে বেশ তরিৎকর্মা। মশালের ব্যবস্থা করে ফেলেছে সে। সিধান্ত নেয়া হলো বাকি দল দুটি কে আমরা আমাদের দলের সাথে যুক্ত করে নিয়ে যাব। পুরো দলটি দাঁড়ালো ২০-২৫ জনের একটি বড় দলে। এখন এই পুরো দলের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো মিশুক কে। সে সবার আগে আগে মশালের আলো নিয়ে যাচ্ছে। তার ঠিক পরেই আমাদের দল ও বাকি ২টি দল। পথ খুব সংকীর্ণ তাই আমাদেরকে ১টা লাইনে ১জন আরেকজনের পিছে এগুতে হচ্ছে। পুরো দলটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম সামনে থেকে আমরা। কিছুটা মিলিটারি স্টাইলে। সবার সামনে থেকে যে ইনফরমেশন আসছে সেটি ততক্ষনাত আমরা আরো ২-৩ জন জোর গলায় পেছনে পৌঁছে দিচ্ছি। পুরো পথেই এবরো থেবরো পাথর, গর্ত আর ছোট খাটো বাঁশের সাকো রয়েছে। সামান্য একচুল এদিক সেদিক হলে সোজা গিরিখাদে পড়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছুনা। সেকারণেই সামনে থেকে পথ নির্দেশনা না দিলে পুরো দলটাই বড় রকম বিপদে পড়তে পারে। মিশুক কিছুদূর পর পর শুকনো ঝোপে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো। যাতে পেছনের সবাই পথ দেখতে পায়। এভাবেই বেশ মজা করেই পুরো দলটাকে লাইনআপ করিয়ে নিরাপদে বগা লেকে পৌঁছে যাই সবাই প্রায় ৯-৯:৩০ টার দিকে।

একেবারে শেষ দিকে এসে আমার ডান হাঁটুতে ক্রাপ্ম হয়ে যায়। আমি আর পা ফেলে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারছিলাম না। আমি আশিক ও তানিমের সাহায্য নিয়ে শেষ অল্প কিছু পথ পাড়ি দেই। প্রচন্ড ক্লান্তিতে দ্রুত খেয়ে ঘুমিয়ে পরি। সকালে আমরা বান্দরবানের উদ্দেশে বগা লেক ত‍্যাগ করি। এই ভ্রমণের বাকি অংশ হয়তো আবার লিখব।

2 Comments

Join the discussion and tell us your opinion.

arefinreply
December 15, 2012 at 4:05 pm

valo likecho,tomar likar vitor puro pahar,pahari jibon oder jibon sobi tule escheche

Mohammad Yearuzzamanreply
December 16, 2012 at 12:13 am
– In reply to: arefin

Thank you very much Shobuj Bhai. I will go again and again ….

Leave a reply