প্রথম পরিচয় ও লিটল উডস (চিঠি – ৪)

প্রিয় জয়ন্তী,

তোমার কি সেই প্রথম দিনের কথা মনে আছে? মনে আছে প্রথম রাতে কথা? আমার অবশ্য তেমন কিছুই মনে নেই। আমি জানিনা কিভাবে পরিচয় হয়েছিল আমাদের। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের পরিচয়ের কিছু স্মৃতি থাকা উচিত ছিল। তুমিও কখনো এ ব্যাপারে কিছু বলনি। কখনই জানার আগ্রহও হয়নি। এখন কি মনে করে এই ব্যাপারে তোমাকে লিখছি ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু তোমাকে লিখতে ভালো লাগছে।

তখনও আমরা ফরেস্ট লনের এই বাড়িতে আসিনি। টাউন সেন্টার এর পাশে এলিস্টন রোডের এ‍্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। গ্রীষ্মের শেষের দিকের কোনো এক রাতেই আমাদের প্রথম কথা হয়েছিল। সন্ধ্যা পেরুনো কোনো এক নিরব রাতে  কেউ একজন পেছন থেকে বল্লো “এই পুলের পানি কতদিন ধরে  পরিষ্কার করনি?” ভেতরের নিঃসঙ্গ ক্লান্তি আমায় চমকে দেয়ার শক্তি টুকুও শেষ করে দিয়েছে যেন। মোটামুটি সব ভাবাবেগ সামলে নিয়ে পেছন ফিরে তাকাই। তোমাকে অন্ধকারে ভালোভাবে দেখতেই পাই নি। আমি তোমার পরিচয় জানার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। যদিও সেদিকে তোমার কোনো উৎসাহই ছিল না বরং তুমি পুলের পাশে রাখা ফুলের গাছগুলির প্রশংসায় ব্যস্ত ছিলে। তুমি আমাকে অবাক হয়ে জিগ্গেস করেছিলে, আমি এখানে একা কিভাবে থাকি। আমিও কিছুটা অবাক হয়ে ভাবছিলাম … “আমি কিভাবে একা থাকি!”

সত্যি বলতে তখনও একা থাকা রপ্ত হয়ে উঠেনি। সারাদিন শেষে আমি এখানে আসতাম। কিছু সময় কাটাতাম এখানে। কখনো হয়ত কয়েক ঘন্টা অথবা কয়েক দিন। এ শহরে আমিও তখন নতুন। সব কিছুর সাথে তখনও পরিচিত হয়ে উঠিনি। আমি মাঝে মাঝে পথ ভুলে বিচিত্র সব নতুন নতুন জায়গা খুঁজে পাই। যেমন একবার পেয়ে ছিলাম ভেলি সাইডের বনসাইয়ের বাগান। পুরনো বামনের বাগান। পরে আবিষ্কার করেছিলাম আমি যদি ভ্যালিটা সোজা পার হয়ে যেতে পারি তাহলে সেটা ঠিক আমার এ‍্যাপার্টমেন্টের উল্টো দিকে। ২০ মিনিট এর হাঁটা পথ খুব বেশি হলে।

ROADবনসাইয়ের বাগানটা বেশ মনকাড়া, নাম “লিটল উডস।” রাস্তার বাইরে উঁচু কাঁচের দেয়াল দেয়াল। ভেতরের কিছুটা অংশ বাহির থেকেই দেখা যায়। আমি এখানেই বাস থেকে নেমেছি। হঠাৎ ভেতরে তাকিয়েই মন হলো ভেতরে যাওয়ার রাস্তা কোনদিকে? আমার ভেতরে যাওয়া দরকার। কাঁচের দেয়ালের শেষ প্রান্তে একটা োছট রুম। ভেতরে ঢুকতেই একটি অল্পবয়সী ছেলের সাথে দেখা। তাকে আমি এই বনসাই বাগানের কথা জিগ্গেস করতেই সে আমার কার্ড ওয়ান টা চাইল। সে আমার এন্ট্রি রেজিট্রি করে ভেতরে ডুকতে দিল। আর হাতে ধরয়ে দিল একটি ছোট্ট ম্যাপ। শত বছরের পুরনো কিছু বনসাইও এখানে আছে। আমি ভেতরে ঢুকে ঘুরে দেখলাম। শান্ত  ছায়া ঘেরা পরিবেশ। সবকিছু দেখে মনে হবে এই বাগানটিও বুঝি শত বছরের পুরনো। কিছু পরিচর্যাকারী বাগানের কাজ করছে। অল্প কিছু দর্শনার্থীও ঘুরে ফিরে দেখছে। আমি একটা বনসাইয়ের সামনে এসে থমকে যাই। এই বনসাইটি খুব পরিচিত এবং নানা পোস্টার, ক্যালেন্ডারে এর ছবি আমি আগেও দেখেছি। স্মৃতির কোনো একটি অংশ আমাকে জানান দিচ্ছিল এটি আমার পরিচিত কিছু একটা। এক ফুটের চেয়ে কিছুটা খাটো শোতর্ধ এই বামন বৃক্ষটিতে হালকা গোলাপী রঙের ফুল ফুটে আছে। এখনো অম্লান আর চির তারুন্য বুকে ধরে রেখে গতিহীন এক জীবনের প্রবাহ ভেসে যাচ্ছে যেন। বাগানের ছোট একটি অংশ আছে যেখানে আছে কিছু অর্কিড। যদিও আমার সব থেকে ভালো লেগেছে বাগান এই সাজানো গোছানো পরিসর টা। প্রতিটা বনসাই আলাদা আলাদা জায়গায় একটা নিজস্ব পরিমন্ডল তৈরী করে রাখা হয়েছে। যেমন বাগানের মাঝে আছে একটি লেক, লেকের পাড়ে কাঠের পুরনো ব্রিজ। কিছু বনসাই আছে যেগুলির চার পাশ ঘিরে বসার জায়গা আছে। তোমার কি মনে আছে আমরা প্রথমবার যখন যাই তখন দক্ষিন দিকের ব্ল্যাক ওকের পাশে বসে কফি পান করেছিলাম। এর পরে আমি অনেকবার গেছি এই লিটল উডসে। কখনো একা অথবা কখনো তোমাকে নিয়ে।

এভাবেই নানা গল্পে আর স্মৃতিতে আমার একা থাকার গুলির কথা তোমাকে বলেছিলাম আমি। যখনই আমি তোমাকে একটি নতুন গল্প বলতাম তখনই তুমি চাইতে তোমাকে যেন আমি নিয়ে যাই সাথে করে কোনো একদিন। আর এভাবেই পরিচয় হতে থাকলো আমার এক অজানা স্বত্তার সাথে খুব ধীরে ধীরে। এর পরে আমাকে আনন্দ, ভালবাসা, দুঃখ, অপেক্ষা আর জীবনবোধের এক অম্লমধুর স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছ এতটা পথ। নিশংঙ্ক চিত্তে ভালবেসেছিলে, নিঃসন্দেহে বিশ্বাস রেখেছিলে, নিরবধি পথ চলার সাহস নিয়ে আজও জেগে আছ দিনমান সারাক্ষন।

Share your thoughts