আগুনের ফুল (চিঠি – 2)
প্রিয় জয়ন্তী,
দক্ষিনের দীর্ঘ সমতলে যখন শীতের হিমশীতল বাতাস বয়ে যায় বিকেল গুলিতে, আমি তখনকার কথা বলছি। আমরা কাজ শেষে ঘরে ফিরে আসার সময় গুলিতে প্রায়ই গল্প করতাম দক্ষিনের সমতলের নদী গুলিতে ছুটি কাটাতে যাওয়ার। অফিস ছুটির পরে যেদিন সুর্য ডোবার আগেই বেরিয়ে পড়তে পারতাম তখন অনেক গল্প করতাম আমরা দুজন। শীতের ঠান্ডা ধুলো ওড়া বিকেল গুলিতে সুর্য ডুবত তখন লালচে হলুদ আকাশে। মাঝে মাঝে আমরা কোনো স্ন্যাক্স সপ এ ঢু মারতাম। আমাদের ঘরে ফেরার তাড়া বলতে তেমন কিছুই ছিলনা। মাঝে মাঝে আমরা ঢুকে যেতাম ব্লু ফ্রেইল মুভি হলে। আর তোমাকে যেন কিছুই কখনো ক্লান্ত করে না। শুধু একরাশ হাসি আর এক জোড়া উজ্জল চোখ মেলে জীবনের সাথে কি নিবিড় বয়ে যাওয়া তোমার!
এক দিনের গল্প বলি। এক দুপুর বেলা কোত্থেকে আমি যেন হাজির হলাম তোমার অফিসে। যথারীতি তুমি আমাকে তোমার রুমে বসিয়ে রেখে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলে। খানিকক্ষণ পরে যখন ফিরে এলে তখন তোমার এক হাতে লাঞ্চের প্যাকেট আরেক হাতে পানির বোতল। পুরনো অত্যাচার। তোমার কাছে দুপুর বেলা তোমার অফিস এ যাওয়া মানে হলো “আমি ক্ষুধার্থ, আমাকে খাবার দাও”। আমার অবশ্য অব্ভেশ হয়ে গেছে আর আমি তোমার অফিস এর খাবার উপভোগও করি। আমি ডান বাম কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করি টুনা সালাদের এর সাথে নোনতা ব্রেড আর ফ্রেশলি চিকেন কাটস। এখনো আমি তোমাকে বিরক্ত করা শুরু করিনি ভেবে তুমি হয়ত কিছুটা আশান্নিত। খাওয়া শেষ করে যথারীতি জাফির সাবিত কে খোঁজা শুরু করা মাত্রই তুমি টের পেয়ে যাও যে, আমার এই মদ্ধ্যাহ্ন অফিস ভ্রমন ও ভোজন মোটেও উদ্দেশ্যবিহীন নয়। আসল উদ্দেশ্য মারাত্মক। সাবিতকে খোঁজার মানেই হলো ব্লু ফ্রেইলে চলমান মুভির আপডেট নেয়া। আর সেটা যে শুধু আপডেট নেয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা এবং আমার সাথে তোমাকে অফিস থেকে ঘন্টা দুই আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে যথারীতি। সাবিত কে বলা হয় মুভি বিশেষজ্ঞ। আমার ধারনা বেচারা তার প্রেমিকাকে এখনো ঝুলিয়ে রেখেছে একটা বিশেষ কারণে সেটা হলো তার ধারণা তার বিয়ে হয়ে গেলে সে সপ্তাহান্তের ছুটিতে মুভি দেখতে পারবে না সারা রাত ধরে। বেচরা ধূসর চোখের সদানন্দ সাবিত।
তোমার অফিসে সময় কাটানো একটা বিশাল আনন্দময় অভিজ্ঞতার ব্যাপার। এখানকার প্রিন্টেড আর্কাইভ হাউজে দুনিয়ার যাবতীয় অদ্ভুত সব প্রকাশনা আছে। এর সব গুলির উপর শুধু নজর বোলাতেই কয়েক মাস লেগে যাওয়ার কথা। এই অফিস এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিষটা হলো এর স্নানাগার (পুল)। উঁচু টিলার উপরে একধারে এই সুরম্য ভবন হওয়াতে যখন এ কেউ এর বিশাল ছাদে উঠে পরে তখন আর এটাকে কোনো দালানের ছাদ মনে হবে না। মনে হবে যেন একটা উঁচু প্রকান্ড টিলার উপরে সমতল সবুজ ভূমিতে প্রকান্ড একটা সুইমিং পুল। এখান থেকে পুরো শহরের পুর্ব পাশ জুড়ে বয়ে যাওয়া নদীর অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। কোনো বিচিত্র কারণেই হোক আর আমার শুৌভাগ্যক্রমেই হোক এই সুরম্য অফিস ভবনের সব কিছুতেই আমার অবাধ প্রবেশাধিকার আছে। এর কারনটা আমার কখনো জানা হয়নি আর আমিও জানার কোনো আগ্রহও পাইনি। আমি সাবিত এর সাথে কথা শেষ করে প্রিন্ট আর্কাইভ নাকি সুইমিংপুল কোথায় যাওয়া যায় সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। এর মাঝেই আমার খোঁজ পড়ে গেল। এবার আমাকে ঝেড়ে কাশতেই হবে। তো মনের একান্ত ইচ্ছা প্রকাশের সাথে সাথেই তীব্র প্রতিবাদ এর সম্মুখীন হলাম যথারীতি । গতকাল রাতেই আমরা সারা রাত মুভি দেখেছি অথচ আজকে কেন আবার মুভি দেখার অজুহাত! আসলে মুভি দেখাটা কোনো কাজের কিছুই নয়। আসল ব্যাপার হলো আমি বিকেলটাতে একেবারেই কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না করার। শহরের এইদিকটাতে চলে এসে তোমার অফিস এ ঢুঁকে যাই যখন, তখনই মনে মনে সিধান্ত নিয়ে ফেলি বিকেলে আমরা কোথায় বেড়িয়ে পড়ব। আর আমার এই সিধান্ত গুলই তোমাকে বিপদে ফেলে দেয়।
আমরা ঠিক করি সন্ধ্যার পরের শো দেখবো অতএব এখনো হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে। আমরা ফ্রয়েড লেনের দিকটায় চলে যাই। শহরের কেন্দ্রের এই দিকটা একেবারে নদীর তীর ঘেঁষে। পুরনো দিনের ইটের মোজাইক রাস্তা ঘাট। কিছু পুরানো বাড়ি এখনো আছে। নদীর তীরের শীতল বাতাসের ঝাপটা বয়ে বেড়ায় শীতের আগমনী। এখনো কিছুটা রোদ যেন এখনো অলস পড়ে আছে। আর তার মাঝেই নদীর পাড়ে অনেকে অলস শুয়ে বসে সময় পার করছে। আজ কিছুটা ভীড়-বাট্টা চারদিকে। আমরা অপেক্ষাকৃত নির্জন একটা কফি শেড এ বসি। আমার মাথায় অনেক কিছু একসাথে ঘুরছে, যেমন ডেমিয়েন কে এই মুহুর্তে দরকর। ও থাকলে নিরানন্দরের কোনো সুযোগ নেই। বেচারাকে খুঁজে বের করা দরকার। কোথায় আছে সে এই মুহুর্তে? ডেমিয়েন কে ফোন দেয়ার সাথে সাথেই তার ট্রেডমার্ক প্রশ্ন! তুই কি ফ্রি আছিস? আমার আর কিছুই বলার থাকে না তাকে ঠিকানা বলা ছাড়া। আমি নিশ্চিত যে সময় ভালই যাবে এখন শুধু ডেমিয়েন এর জন্য অপেক্ষা। এই মুহুর্তে যে জিনিস গুলি তুমি মনোযোগ দিয়ে করবে সেটা হলো তোমার ব্যাগ থেকে দুটো বই বের করবে একটা আমাকে দিবে আরেকটা তুমি খুলে পড়া শুরু করবে। অলস সময়ে বই এর পাতা নাড়া চাড়া করা বেশ উপভোগ্য বটে কিন্তু তোমার পছন্দের বই গুলি বেশ খট-মট। বইয়ের মাঝে ২-৪ টা ছবি থাকে এই যা প্রশান্তি নইলে এই বই গুলি পরার ধৈর্য্য আমার থাকার কথা নয়। ডেমি আসার আগ পর্যন্ত সময় কাটানোর এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এখানে। তোমাকে বই পড়া থেকে বিরত করতে ইচ্ছে হচ্ছে না এই মুহুর্তে।
হয়ত এরকমই আরেকটা বিকেলে আমরা আবার বেড়িয়ে পড়বো তোমার যত ব্যাস্ততা উপেক্ষা করে। আমি আবারো গভীর ভাবে অনুভব করি এই এক জীবনে আমার কোনো দাবিই তুমি উপেক্ষা করনি সেটা যত সাধারণই হোক বা যত অসাধারণই হোক। কি এক বিশাল মমতায়-ভালবাসায় তুমি আমার সব যন্ত্রণা বয়ে যাও নিরোবোধী।